একদিন এই ক্লাসরুম ছিল মো. ওসমান পাটোয়ারীরও। শান্ত-সৌম্য ছেলেটাই টিফিনের ছুঁটিতে হয়ে উঠতেন উচ্ছল। হাসি-গান-আড্ডায় মাতিয়ে রাখতেন বন্ধুদের। আজ সবই স্মৃতির পাতায়। লক্ষ্মীপুর থেকে একবুক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বন্দরনগরীর চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়তে আসা ছেলেটা এখন কেবলই ছবি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া ওসমানের বুক-শরীর ঝাঁজরা হয়েছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে।
প্রায় দুই মাস আগে শহীদ হলেও ফের বন্ধুদের স্মৃতিতে ফিরলেন ওসমান, সেই তারই রেখে যাওয়া চেনা পরীক্ষার হলেই।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ওসমানও ছিলেন কম্পিউটার বিভাগের এই বর্ষেরই শিক্ষার্থী। কিন্তু দেশকে নতুন ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ এনে দিতে প্রাণ দেওয়া ওসমান পাটোয়ারী স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষার হলে থাকতে পারেননি। তবে পরীক্ষার হলে ওসমান আগে যে টেবিলসহ লাগানো চেয়ারটিতে বসতেন সেটিতে বসেননি কেউ। সেই শূন্য চেয়ারের ওপরে শোভা পাচ্ছিল ওসমানের জন্য বন্ধুদের আনা ভালোবাসার ফুলের তোড়া।
পরীক্ষার খাতায় লিখতে লিখতে কখনো কখনো বন্ধুদের চোখ চলে যাচ্ছিল সেই খালি চেয়ারের দিকে। বন্ধুর চলে যাওয়ার পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে স্বভাবতই অনেকের চোখের পাতা ভারী হয়ে গিয়েছিল।
ফেসবুকের পাতায় সেই কথা তুলেও ধরেছেন ওসমানের বন্ধুরা। তাদেরই একজন মো. এরফান। তিনি লেখেন, ‘ওসমান, কখনো ভাবিনি তোকে ছাড়া পরীক্ষা দিতে যাবো। ডিপ্লোমা লাইফের শুরু থেকেই আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে ক্যাম্পাসে যেতাম। কতই না মজা করতাম। এইগুলা কখনো ভুলবার নয়। আজ সবই আছে শুধু তুই নেইরে বন্ধু!’
আরেক বন্ধু শোকের শব শব্দকে জড়ো করে লিখলেন, ‘প্রিয় ওসমান, পলিটেকনিকের ভর্তি হওয়ার ফার্স্ট সেমিস্টার থেকে তোর সঙ্গে ৩০৬ নম্বর কক্ষে মিডটার্ম পরীক্ষা দিয়ে আসছি। আজ ৪র্থ পর্বের মিডটার্ম পরীক্ষা দিলাম সেই ৩০৬ নম্বর কক্ষে। তোর সিটও একই জায়গায় ছিল। কিন্তু ভাই শুধু ছিলি না তুই।’
একসঙ্গে ক্লাসরুম শেয়ার, শহরের এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি-সাজিদ ইমতিয়াজের মনের উঠোনো ওসমানের সঙ্গে কাটানো সেই সব স্মৃতি যেন এখনো খেলা করছে।
সেই আনন্দের স্মৃতি থেকে কিছুটা ধার নিয়ে সাজিদ বড় দুঃখ করে বললেন, ‘ওসমান ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হলে সে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঘরে বসে থাকেনি, আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল সেখানকার বন্ধুদের সঙ্গে। ৪ আগস্ট বিকেলে লক্ষ্মীপুর শহরে গুলিতে সে শহীদ হয়। দেশের জন্য বন্ধুর এই আত্মত্যাগের স্মৃতিকে আজীবন ধরে রাখতে চাই আমরা।’
ওসমানের বড় ভাই মো. ওমর ফারুক কদিন আগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আহ্বানে ঘুরে গিয়েছেন ছোটা ভাইয়ের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটউটে।
তারই স্মৃতি ফেসবুকে তুলে ধরেছেন ফারুক। লেখেন, ‘দেখে এসেছি প্রিয় ওসমানের হেঁটে চলা রাস্তাগুলো, ক্লাসরুম, শিক্ষাঙ্গন, পড়ার টেবিল, থাকার স্থান। ওসমানকে ছাড়া সবই আছে। কলেজ ড্রেসটা যেভাবে হাতা গুটিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুঁলিয়ে রেখে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই ঝুঁলে ছিল। ওসমান ছাড়া সব যেন থমকে আছে, হাহাকার করছে। প্রিয় চট্টগ্রাম তুমি থাকবে হৃদয়ে, ভাইয়ের স্মৃতি যে রেখে এসেছি তোমার বুকে।’
ওসমানের সেই স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন তারই বন্ধুদের কাঁধে। বন্ধুবিয়োগে শোকের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া বন্ধুরাও অবশ্য ওই স্মৃতি আঁকড়েই বাঁচতে চান, প্রতিদিন, আজীবন!