নতুন করে ফিরে পাওয়া জীবন

নতুন করে ফিরে পাওয়া জীবন

ডা. রাহনূমা পারভীন

সারা বিশ্বে দিনদিন ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি নিত্য নতুন আধুনিক চিকিৎসা আবিষ্কারের ফলে ক্যান্সারজয়ী যোদ্ধার সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে ক্যান্সার মানেই শুধু মৃত্যুর পরোয়ানা, তা কিন্তু নয়।

নতুন করে ফিরে পাওয়া জীবনকে উদযাপনে উৎসাহিত করতে সকল ক্যান্সার সারভাইভারদের জন্য প্রতি বছরের জুন মাসটি ক্যান্সার সারভাইভার’স মাস হিসেবে পালিত হয়। আর জুন মাসের প্রথম রবিবার উদযাপন করা হয় ক্যান্সার সারভাইভার’স দিবস। ১৯৮৮ সালে সর্বপ্রথম এই দিবসটি পালন করা শুরু হয়। তবে পুরো জুন মাস জুড়েই ক্যান্সার সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ক্যান্সার যোদ্ধা ও তাদের পরিবার-পরিজন এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার সাথে জড়িত সকলে বিভিন্ন আয়োজনে অংশগ্রহণ করে থাকে।

জীবনের কোন এক সময়ে যাদের কোন একটি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে এবং যারা ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন তারা সকলেই ক্যান্সার সারভাইভার। ‘ক্যান্সার সারভাইভার’ বলতে শুধু ক্যান্সার থেকে পুরোপুরি নিরাময় লাভ করা ব্যক্তিদের বোঝানো হয়না। আসলে এই শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থ বহন করে। ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশাপাশি তার পরিবার, আত্মীয়-পরিজন ও সেবাদানকারী সকলেই এই ‘সারভাইভার’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত।

ক্যান্সার রোগ একবার শণাক্ত হলে অনেকদিন ধরে এর ব্যয়বহুল চিকিৎসা চলার পর একসময় তা শেষ হয়। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বহুদিন পর্যন্ত সেই ক্যান্সার সারভাইভারদের উপর পরিলক্ষিত হয়। ক্যান্সার চিকিৎসার দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, প্রচন্ড অর্থনৈতিক চাপ ও মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি যুক্ত হয় পুনরায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। এর প্রভাব থেকে সমাজও রক্ষা পায়না। তাই ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য প্রয়োজন সামাজিক পুনর্বাসন ও মানসিক সমর্থন।

এ কারণে শুধু ক্যান্সারের চিকিৎসা করিয়েই একজন ক্যান্সার রোগীর প্রতি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ক্যান্সারকে জয় করে নতুন করে বাঁচতে শেখা মানুষগুলোকে অনুপ্রাণিত করা ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করাও আমাদের দায়িত্ব। সেই সাথে তাদের পরিবার পরিজনসহ সমাজের সকলের মধ্যে ক্যান্সার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি উপলক্ষ্যও এই ক্যান্সার সারভাইভার’স মাস। শুধু তাই নয়, নতুন করে যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সবেমাত্র যুদ্ধ শুরু করেছেন, তাদের জন্যও এই উদযাপন অনুপ্রেরণা স্বরূপ।

ক্যান্সার সারভাইভারদের জন্য করণীয়

একবার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে পুনরায় ঐ একই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অথবা দ্বিতীয় কোন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি। তাই এ ব্যাপারে তাদের সচেতন থাকতে হবে। চিকিৎসা পরবর্তী সময়েও তাদের জন্য চিকিৎসকের দেওয়া সকল পরামর্শ ও নিয়মাবলী মেনে চলতে হবে।

প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে (২.৫ কাপ) শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া উচিত। অনেকেই মনে করেন, এন্টি-অক্সিডেন্ট ট্যাবলেট, ভিটামিন ও মিনারেল পিল ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ট্যাবলেট বা পিলের মাধ্যমে যে এন্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন খাওয়া হয় তা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারেনা। এগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ঠিকই, তবে তা প্রাকৃতিক উৎসজাত হতে হবে। অর্থাৎ প্রতিদিনের খাবারে এগুলোর আধিক্য থাকতে হবে (শাকসবজি ও ফলমূল)।

লাল মাংস (গরু, খাসি, ভেড়া, শুকর) ও প্রক্রিয়াজাত মাংস (সসেজ, বেকন, সালামি) সীমিত পরিমানে খাওয়া। সেই সাথে গোটা শস্যের তৈরি খাবার (whole grain) খেতে পারলে ভালো হয়।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা।

দেহের আদর্শ ওজন বজায় রাখা। অলস জীবন যাপন ও ওজন বৃদ্ধি রোধ করা।

ধূমপান সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা, মদ্যপান না করা।

নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে অর্থাৎ ফলো আপ বা চেকআপে থাকা। প্রয়োজনে ক্যান্সার স্ক্রিনিং-এ অংশ নেয়া।

ক্যান্সার ফিরে আসার লক্ষণগুলো সম্পর্কে সতর্ক হওয়া। যেমন, অনাকাঙ্ক্ষিত ওজন হ্রাস, খাদ্যে অরুচি, বারবার জ্বর আসা, দীর্ঘদিন যাবৎ কাশি ভালো না হওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, শরীরে পানি আসা, বারবার মাথাব্যাথা হওয়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, কোন আঘাত ছাড়াই দেহের বিভিন্ন স্থানে অস্বাভাবিক ব্যাথা অনুভূত হওয়া, শরীরে নতুন করে কোন চাকা খুঁজে পাওয়া প্রভৃতি।

এছাড়াও প্রথমবার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সময় শরীরে যে সকল লক্ষণ দেখা দিয়েছিল সেগুলোও স্মরণে রাখতে হবে। যে কোন অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

ক্যান্সার সারভাইভারদের জন্য উৎসর্গীকৃত এই মাসে আসুন আমরা সকলে ক্যান্সার যোদ্ধাদের সহযোগী হই, ক্যান্সার সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হই, ক্যান্সারকে জানি, ভালো থাকি, সুস্থ থাকি।

লেখক: ক্যান্সার ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ

সারাবাংলা/এসবিডিই

Scroll to Top