টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করলেও দেশের ৫টি বিশেষায়িত ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে, এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন প্রোপাগান্ডা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে তা আমাদের পলিসি ইনেশিয়েটিভ।
তিনি দাবি করেছেন, তথাকথিত কিছু অর্থনীতিবিদ তাদের সব বিষয়ে ‘বাছবিচার না করে’ কথা বলার প্রবৃত্তি থেকেই এই ভিত্তিহীন প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন। দেশের অর্থনীতির ইতিবাচক গতিপ্রবাহ বজায় রাখতে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা সংকট সৃষ্টি না করার জন্য অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও গণমাধ্যমের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। দেশের শীর্ষ মাল্টিমিডিয়া নিউজপোর্টাল বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন মেজবাউল হক।
বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করলেও দেশের বিশেষায়িত পাঁচটি ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে মর্মে অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত ঘটনাটি আসলে কি?
মেজবাউল হক: এখানে জানতে হবে যে, ব্যাংকের লিকুইডিটি (তারল্য) আসলে আমরা কিভাবে এনশিওর করি। আমরা বলি যে চার পার্সেন্ট নগদ রিজার্ভ অনুপাত বা সিআরআর রাখবেন। ধরুন কোন ব্যাংক যদি ১০০টাকা ডিপোজিট করে, তবে তাকে ৪ পার্সেন্ট সিআরআর আর নন-ক্যাশ আকারে ১৩% এসএলআর, মোট ১৭ % রাখতে হয়। কেন রাখতে হয়? কারণ যে ব্যক্তি এই ১০০ টাকা রাখলেন তাঁর টাকার প্রয়োজন হতে পারে। তার তো ৫০ টাকাও প্রয়োজন হতে পারে, এই ১৭ টাকায় কি তাহলে হবে? আমি তাহলে এই ১৭ টাকার কথা কেন বললাম, সচারাচর ১৭ টাকা হচ্ছে আমাদের একটি স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস। কোন গ্রহিতার যদি ৩০ টাকা প্রয়োজন হয় তখন কি হবে? হয়তো ব্যাংকে আরও ২ যোগ করে ২০ টাকা দিতে পারলো বাকিটার কি হবে? তখন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাকি ১০টাকা নেওয়ার জন্য আমাদের (বাংলাদেশ ব্যাংক) কাছে আসবে। আমি কি তাকে ফিরিয়ে দেব?
বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশ ব্যাংক তো অভিভাবক প্রতিষ্ঠান…
মেজবাউল হক: আমি যদি তাকে ফিরিয়ে দিই তাহলে তো আমার অর্থনীতি চলবে না। তাহলে তো সব ব্যাংককে সব টাকা নিয়ে বসে থাকতে হবে, কাউকে লোন দেওয়া যাবে না। সেই জায়গাতে সেন্ট্রাল ব্যাংকের এই এস্যুরেন্সটা আছে, তা হচ্ছে কোন ব্যাংক সংকটে পড়লে তাকে সহযোগিতা দেওয়া। এটাই সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাজ।
বার্তা২৪.কম: এটি তো তাহলে খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া…
মেজবাউল হক: একদমই স্বাভাবিক। ধরুন, কাল যে ব্যাংকটি ১০ টাকা নিয়ে গেল, ৩০টাকা মিলিয়ে গ্রাহককে দিল, পরের দিন এমন হতে পারে যে সেই ব্যাংক একটি ৫০ টাকার ডিপোজিট পেয়েছে। এটা তো আর ওই দিনই লোন দিবে না। লোন প্রসেস করে দিতে সময় লাগবে। তখন সেই ব্যাংক ৫০ টাকার ডিপোজিট রাখছে, ওই ১০টাকা শোধ করে বাকী ৪০ টাকাও রাখলো-দিস ইজ হাউ লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট ইজ ডান…এটাই ব্যাংকিং সিস্টেম (রূপকঅর্থে ১০০টার একটি হিসেব দিয়ে আমি বিষয়টি তুলে ধরলাম)। এই সিচুয়েশন কয়টা ব্যাংকের হবে? ধরুন-৩টি ব্যাংকের হবে। বাকীরা ঠিক থাকবে। পরের দিন হয়তো ৫টি ব্যাংকের হতে পারে। আবার হয়তো কোন একটি ব্যাংক লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্টে ভুল করেছে, তার জন্য প্রেসার ক্রিয়েট হবে, বা কোন ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেল। তখন সেই ব্যাংকটির ক্রেতারা আমানত বেশি তুলতে চাইবে। এগুলো সবই হচ্ছে একটা পার্ট অব দ্য সিস্টেম, নাথিং নিউ।
বার্তা২৪.কম: টাকা ছাপিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি তাহলে কি?
মেজবাউল হক: একটি ব্যাংকে ধরুন, গতকাল ১০টা দিয়েছি, পরের দিন তো ওই ব্যাংক ১০টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে; তাহলে কি আগের অর্থটা ছিড়ে ফেলা হয়েছে? তার মানে সিস্টেমে শর্টটার্ম ম্যানেজমেন্টের জন্য মানি একদিন বা দু’দিনের জন্য ক্রিয়েশন হবেই, দিস ইজ পার্ট অব দ্য সিস্টেম। অর্থ ছাপানোটা কখন বলি, যখন দেখি যে ব্যাংকটি ১০ টাকা নিয়েছে, ২ বছর পরিশোধ করে না। তাহলে এই ১০ টাকা এডিশনাল ইঞ্জেকশন হয়েছে, যেটি কাল পরিশোধ করে দিবে সেটি কি অর্থ ছাপানো হলো? সাময়িকভাবে আজকের জন্য গেছে, কাল আবার পরিশোধ হয়ে যাবে…তাহলে অর্থ ছাপানো মানে টা কি?
বার্তা২৪.কম: ‘টাকা ছাপানো’প্রপোগান্ডার আসলে ভিত্তি কি?
মেজবাউল হক: এটার কোন ভিত্তি নেই। এটা হচ্ছে কিছু তথাকথিত ইকনোমিস্ট যাঁরা এই সিস্টেম সম্পর্কে উপরে-উপরে জানেন যে সেন্ট্রাল ব্যাংক টাকা দিলে মানি সাপ্লাই বাড়ে, না দিলে বাড়ে না। আমি যে প্রতিদিন টাকা দিচ্ছি, প্রতিদিন টাকা তুলছি, এটা হয়তো উনার জানা নেই। উনি তো মনে করছেন যে ওই ব্যাংকে সেন্ট্রাল ব্যাংক টাকা দিয়ে ভাসিয়ে ফেলছে…
বার্তা২৪.কম: তাই যদি সত্য হয়-তবে অর্থনীতির মানুষ হয়ে যিনি এ ধরণের বক্তব্য দিচ্ছেন, সাধারণ মানুষের কাছে সেটি কি বার্তা যাচ্ছে…
মেজবাউল হক: এই চ্যালেঞ্জটা করবে কে? ওই অর্থনীতিবিদের আসলে (যিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমে এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন) গণমাধ্যমের ক্যামেরা দেখলেই উনার কথা বলতে মন চায়। উনার রিলেভেন্ট কি না, বলা উচিত না বলা উচিত না-উনি কোন বাছবিচার করছেন না। তার মানে হচ্ছে যে তিনি আসলে কথা বেচে খান। অনেক গুণী অর্থনীতিবিদ আছেন, যাঁরা প্রাসঙ্গিক নন-এমন বিষয়ে মন্তব্য করেন না। কারণ তিনি জানেন, একদিনের কোন বিষয়কে ফেনোমেনান ধরা যায় না। সেন্ট্রাল ব্যাংকের কিছু আছে ডে টু ডে ম্যানেজমেন্ট, এটা আমরা করবই। সেন্ট্রাল ব্যাংকের ট্রাডিশনাল রুলই হচ্ছে এটা।
বার্তা২৪.কম: যেভাবে বলা হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে, আপনার মূল্যায়ন কি?
মেজবাউল হক: হ্যাঁ, গভর্ন্যান্স ইস্যু থাকতে পারে, সব ব্যাংকেই কমবেশি থাকবে কিন্তু ইসলামী ব্যাংক-সাচ এ ব্যাংক, আপনি আমাকে দেন, যা নিয়েছেন তা কাভার করে লাভ দেব এক বছরের মধ্যে। এই ব্যাংকের ফান্ডামেন্টালসটা এতো স্ট্রং (ইসলামী ব্যাংকসমূহের)। হিসাব করুন, আমাদের এখনও ৪০ ভাগ ফরেন রেমিটেন্স ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আসে। ১০০ মিলিয়ন যদি আসে রেমিটেন্স তাহলে ৪০ মিলিয়ন ইসলামী ব্যাংকের। ৪০ মিলিয়নে ১ টাকা করে লাভ হলে লাভ হবে ৪ কোটি টাকা। ৪ কোটিকে ১ বছরে মাল্টিপ্লাই করলে কত দাাঁড়ায়…এখন উনি তো বলছেন সব শেষ হয়ে গেল! হ্যাঁ, কিছু ড্রেনেজ হচ্ছে; কিন্তু সেটা বন্ধ করলে তো কালই দাঁড়িয়ে যাবে। তাই বলে কি ইসলামী ব্যাংক বন্ধ করে দেব? সাপোর্ট দিয়ে একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবং ওই যে ড্রেনেজটা এটাকে বন্ধ করতে হবে। ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন আছে, আমরা করছি না তা নয়। তারল্য সংকটের কথা বলা হচ্ছে, আমরা পলিসি রেট ইনেশিয়েট করছি, এটা আমাদের পলিসি ইনেশিয়েটিভ, আপনারা বলেছেন, ডিউ টু লিকুইডিটি ক্রাইসিস অব দ্য ব্যাংকস…আমরা তো চাচ্ছি ফান্ড ক্লিয়ার হোক, ব্যাংকের কাছে ফান্ড কমে যাক, আমার ইনফ্লেশন কমবে। এটা তো আমার পলিসি ইনেশিয়েটিভ। আপনি সাজাচ্ছেন ব্যাংকগুলো ক্রাইসিসে আছে। আমরা যে ইন্টারেস্ট রেট ১২ পার্সেন্টে নিয়েছি এটা খেয়াল করতে হবে না? দিস ইজ হ্যাপেনিং ডিউ টু বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি…সেন্ট্রাল ব্যাংক এটাই চাচ্ছে। হ্যাঁ, আমরা যখন দেখছি টাকা নিতে নিতে আপনার কাছে ভাত খাওয়ার টাকা থাকছে না, তখন তো আমরা আবার দিচ্ছি…
বার্তা২৪.কম: গণমাধ্যম ও অর্থনীতিবিদদের কাছে আপনারা কেমন দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করেন?
মেজবাউল হক: সবারই একটা দায়িত্ব আছে। আমি আমার জায়গায় দায়িত্বশীল হব, আপনি আপনার জায়গায় দায়িত্বশীল হবেন-সত্য কথাটা মানুষকে জানতে দিতে হবে। যে কোন জিনিসের দু’টি ফেস থাকে-একটি রিয়েল ফেস অন্যটি বিহাইন্ড দ্য ফেস। আমরা সব সময় কাজ করি রিয়েল ফেস নিয়ে। এই যে বললাম..লিকুইডিটি প্রবলেম..যদি ১০টি ব্যাংক থাকে; তাহলে ১০ জনের লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট এক রকম থাকবে না। দেখা যাবে ২ জন লিকুইডিটি ট্র্যাকে আছে। ধরুন, আজ আপনাকে আমার হাজার কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার কথা, শেষ মুহূর্তে এসে বললাম-আজ নয় কাল হবে। আপনি কি আপনার গ্রাহককে বলতে পারবেন আজ নয়, কাল দেব? তখন হয়তো আপনি সেন্ট্রাল ব্যাংকে ছুটে আসবেন যে আমাদের অস্থায়ী ফান্ড দেওয়ার জন্য..তাদের এই ম্যানেজমেন্ট করতে হবে নইলে গ্রাহকদের আস্থা থাকবে না। এটা আমার রেগুলার ফাংশন। আমাকে বলা হয়েছে, এটা করার জন্য। আমরা এটা করার পর যদি আপনি বলেন, কেন এটা দিলেন আপনি? তাহলে তো বলবো, আপনি তো আমার ম্যান্ডেটই পড়েননি। মনিটারি পলিসিতে এটা স্পষ্ট বলা আছে, এটি আমাদের ম্যান্ডেট। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে বলা আছে এটি, তবুও কি আমি তাকে দেব না?
বার্তা২৪.কম: এই ধরণের প্রপোগান্ডায় অর্থনীতিতে কি ধরণের প্রভাব ফেলে?
মেজবাউল হক: বৈদেশিক বিনিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রেই এটি নেতিবাচক প্রভাব পেলে। লক্ষ্য করে দেখবেন, এখন অনেক শান্ত। যখন একটা কিছু হয়, তখন সবাই অপর্চুন মোমেন্ট খোঁজে…সেই অপর্চুন মোমেন্টে মানুষ কোনটা খাবে? এটা তাঁরা খুব সচেষ্ট থাকেন..ওইটাকে তখন প্রমোট করা শুরু করে। এই জায়গাটায় আরও দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে। শুধু চটকদার নিউজ করার জন্য নিউজ করব, এই প্রবণতা ঠিক নয়। চিন্তা-ভাবনার বিষয় আছে। রিয়েল নিউজটা করুন। সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রত্যেকটা পলিসির একটা পয়েন্ট অব ভিউ আছে। আমাদের প্রত্যেকটা অ্যাকশনের একটা ব্যাখ্যা আছে। সেই ব্যাখ্যা ভুল হতে পারে, সঠিক হতে পারে। সেটার ক্রিটিসিজম ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যদি সেন্ট্রাল ব্যাংকে এমন একটা জায়গায় ধাবিত করেন যে সেটা ভুল, তা তো গ্রহণযোগ্য নয়। আমি ৬০-৬১টি ব্যাংক অপারেট করছি, কেউ এসে আমাকে বলতে পারে আমার টাকা প্রয়োজন। দুটি উপায়ে আমরা টাকা দিই-প্রথমত: সিকিউরিটি রেখে আর ইসলামী ব্যংকগুলোর জন্য বলেছি, দেয়ার ইজ এ প্রবলেব.. কারণ এগুলোর কাছে adequate security নাই। কারণ দেশে ইসলামিক ইন্সট্রুমেন্ট নেই। আমরা বলেছি যখন লিকুইডিটি প্রবলেম হবে, ম্যানেজমেন্ট প্রবলেম হবে-তখন সেন্ট্রাল ব্যাংক দেখবে।
‘এক হাতে টাকা ছাপানো বন্ধ করে আরেক হাতে টাকা ছাপছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা দেওয়া হচ্ছে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংককে টিকিয়ে রাখার জন্য’-পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের এই মন্তব্যের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান জানতে দেশের আর্থিক খাতের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রের মুখোমুখি হয়েছিল বার্তা২৪.কম। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে পূর্বোক্ত মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর।