আজ ১২ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার মুক্ত হয় নরসিংদী জেলা। এই দিনে সম্মিলিত মুক্তি বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে তাদের আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে নরসিংদী শহরসহ গোটা জেলা হানাদার মুক্ত হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি নরসিংদীবাসীর কাছে অত্যন্ত গৌরবোজ্জল ও স্মরণীয় দিন। প্রতি বছরই দিবসটিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে নরসিংদী জেলা প্রশাসন সহ স্থানীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।
দীর্ঘ ৯ মাস জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওই যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য বীর সন্তান। এছাড়া বহু মা-বোনের নিরব আত্মত্যাগের বিনিময়ে নরসিংদী হানাদার মুক্ত হয়।
রাজনৈতিকভাবে অগ্রসরমান রাজধানী ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এক অদম্য শক্তি নিয়ে, স্বপ্রণোদিতভাবে। যুদ্ধ অনভিজ্ঞ, তরুণ ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা প্রতিশোধ স্পৃহায় অটুট মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মরণস্ত্রের চেয়ে মনোবলই যে অধিকতর শক্তিশালী পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে তার প্রমাণ রেখেছেন নরসিংদীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ এ পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে করে এখনো ভয়ে আতকে উঠেন নরসিংদীবাসী। স্বজন হারানোদের কান্নায় এখনও ভারী হয়ে উঠে আকাশ-বাতাস। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষী হয় জেলার বেশকিছু গণকবর। বর্তমান সরকার গণকবরগুলো সংরক্ষণ করার কাজ শুরু করেছেন। এরই অংশ হিসেবে জেলার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
যুদ্ধ অংশগ্রহণকারী কয়েকজন যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধা নূরে আলম, ইব্রাহিম ও শাহজাহান জানান, নরসিংদীর এমন কোন স্থান নেই যেখানে ৭১-এ শত্রু সেনাদের নিষ্ঠুর ছোবল পড়েনি। ১৯৭১ সালে নরসিংদী জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই নরসিংদী জেলায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ৭১’এ বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে নিয়ে পাকসেনাদের ক্যাম্প নিয়ে নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন ব্রীজের নীচে। সেখানে বসিয়ে রেখে তাদের গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। হত্যা শেষে ব্রীজের নীচে সকলকে একসাথে মাটি চাপা দেওয়া হয়। আজও স্থানীয়দের কানে সেদিনের আত্মচিৎকার ভেসে আসে। বোমা বর্ষণ ও নরসিংদী দখলের পর পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের ফলে বিক্ষুদ্ধ অসহায় জনতা আক্রোশে ফুসতে থাকে।
নরসিংদী জেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল মোতালিব পাঠান জানান, নরসিংদীতে নেভাল সিরাজ ও মনির উদ্দিনসহ ছোট বড় ১২টি গ্রুপ ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে, মাধবদী, পাঁচদোনা, জিনারদী, রায়পুরা, পুটিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে তাদের পরাস্ত করে নরসিংদী মুক্ত করেন।
৭১’এর মার্চে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নরসিংদীতে ই.পি.আর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। এতে হাজার হাজার ছাত্র জনতা তাদেরকে স্বাগত জানায়। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে শত শত যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে শুরু হয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও চোরাগুপ্তা হামলা। স্থল পথে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পাক হানাদার মুক্ত হয় নরসিংদী ।
মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী জেলা ছিল ২নং সেক্টরের অধীনে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। নরসিংদীকে ৩ নং সেক্টরের অধীনে নেয়া হলে কামান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মোঃ নূরুজ্জামান।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবোজ্জল ভূমিকা রয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন স্থানে শত শত নারী পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল পাকবাহিনী। গণকবরগুলোর বেশিরভাগই চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমান সরকার এসব চিহ্নিত স্থানগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম জানান, ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী হানাদার মুক্ত হয়। এই দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো বড় আকারে বিজয় কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। আজকের তরুন প্রজন্ম নরসিংদী মুক্ত দিবসের সঠিক ইতিহাস বলতে পারেনা। তাই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নরসিংদীতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার জন্য এই বিজয় কনসার্টের আয়োজন।