সারাদিন ঘুমায় যে ঘোড়া!

সারাদিন ঘুমায় যে ঘোড়া!

উভয় বাংলার অন্যতম লোকউৎসব পৌষপার্বণ। যা বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৌষের শেষ দিকে এই উৎসবের প্রস্তুতি চলে। বাহারি পিঠাপুলি এবং গ্রামীণ খেলাধুলার মাধ্যমে উদযাপন করা হয় উৎসবটি। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া, মুক্তাগাছা ও ত্রিশালে পৌষ সংক্রান্তির এই দিনটি উদযাপন করা হয় এক ভিন্ন আমেজে। এই অঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তির উৎসবকে জোরালো এবং উৎসবের নান্দনিকতাকে আরো উৎকর্ষ করতে আয়োজন করা হয় হুমগুটি খেলা।

হুমগুটি খেলা উপলক্ষে ফুলবাড়িয়ার আশপাশের এলাকা সাজে নতুন এক রূপে। চারোদিকে বিরাজ করে উৎসব উৎসব ভাব। মানুষের মুখে লেগে থাকে ঝলমলে হাসি। মনের ভিতর থাকে চাপা উত্তেজনা। এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসে লোকজ মেলা। রাস্তার দুপাশে থাকে ছাউনি ঘেরা বিভিন্ন দোকান। বাবার বাড়িতে নাইওর আসে আদরের মেয়েরা। বাড়িতে বাড়িতে সমাগম ঘটে কাছে দূরের স্বজনদের। আশপাশে জবাই করা হয় প্রায় হাজারখানেক গরু। প্রতিটি বাড়িতে চলে রান্নাবান্না ও পিঠাপুলির উৎসব। এলাকার প্রতিটি মানুষ মুখিয়ে থাকেন এই দিনটির অপেক্ষায়।


ভয়ঙ্কর একটি খেলা হুমগুটি। এই খেলার গোড়াপত্তন হয় প্রায় ২৬৪ বছর আগে। তৎকালীন মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্তের সঙ্গে ত্রিশালের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিরোধ মীমাংসা করতে লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে তালুক-পরগনার সীমানায় এই গুটি খেলার আয়োজন করা হয়। খেলায় বিজয়ী হয় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর এটি সম্পূর্ণরূপে সাধারণ মানুষের খেলায় পরিণত হয়।

হুমগুটি পিতলের তৈরি। আকারে প্রায় ছয়টি ফুটবলের সমান। ওজন প্রায় এক মণ। হুমগুটি সারা বছর গ্রামের মোড়লদের তত্ত্বাবধানে থাকে। কয়েকটি এলাকা মিলে ‘হুমগুটি খেলা উদযাপন কমিটি’ গঠন করা হয়। খেলা পরিচালনার দায়িত্ব থাকে সেই কমিটির ওপর। এ বছর ২৬৫তম হুমগুটি খেলা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৪ জানুয়ারি, রোববার।


খেলা শুরু হয় বিকেল ৩ টায়। তাই তালুক-পরগনা সীমানায় সকাল থেকেই দর্শক জড়ো হতে থাকে। গুটি নিয়ে এলে রাস্তায় পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করা জায়গা থেকে শুরু হয় খেলা। খেলা শুরু হওয়ার পর আর বিশেষ কোনো দায়িত্ব থাকে না উদযাপন কমিটির।

এই খেলায় নির্দিষ্ট কোনো দল বা রেফারি নেই। যে কেউ যে কোনো জায়গা থেকে দল নিয়ে এসে খেলতে পরে। কোনো রকম ফি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কেউ চাইলে এককভাবে এসেও খেলতে পারে। খেলা শুরুর সময় চারদিক হিসাবে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম থেকে একজন করে মোট চারজন গুটি হাতে নিয়ে বুকের কাছে উঁচিয়ে ধরেন।

এরপর ধাক্কাধাক্কিতে চলে খেলা। উপস্থিত লক্ষাধিক মানুষের সবাই খেলোয়াড়। চাইলে যে কেউ ধাক্কা দিতে পারেন। সবাই ধাক্কা দেন না। তবে চারদিক থেকে হাজার হাজার খেলোয়াড় ধাক্কা দেন। গুটির সাথে যে শতাধিক লোক থাকেন তারা একেবারে চেপ্টা হওয়ার উপক্রম হন। সবচেয়ে হৈহুল্লোড় হয় যখন গুটি কোনো পুকুর বা খালে পতিত হয়। শতাধিক খেলোয়ার পৌষের শীত উপেক্ষা করেই নেমে পড়েন ঠাণ্ডা পানিতে। তাই শক্তি সামর্থ্যবান লোক ছাড়া এই খেলায় অংশ নেওয়া ঝুঁকির ব্যাপার। তবুও সেসব ঝুঁকি উপেক্ষা করে অসংখ্য তরুণ-বৃদ্ধ খেলায় অংশ নেন।

এই খেলার নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। গুটি যেখানে অবস্থান করে সেটিই তার মাঠ বলে বিবেচিত হয়। আমন ধান কাটার পর এই খেলা হলেও ক্ষেতে যাদের অন্যান্য ফসল থাকে ধাক্কাধাক্কিতে গুটি সেখানেও চলে যেতে পারে। তাই সাধারণ মানুষ এবং কমিটির পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকে ফসলের ক্ষেত বা মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রক্ষা করার জন্য। এই খেলায় কেউ পদদলিত হয়ে মারা গেছে বা গুরুতর আহত হয়েছে এমন কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। কেউ যদি নিচে পড়ে যায় তাহলে উঠার জন্য সবাই সহযোগিতা করে।

প্রতিটি দল ভিরের মাঝে নিজেদের চিহ্নিত করার জন্য নির্দিষ্ট প্রতীক ব্যবহার করে। এক দিকের দল যখন ভালো খেলে তখন বাকি তিন দিকের দলগুলো একত্রে সেই দলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রতিটি দলেরই প্রবল ইচ্ছা থাকে কৌশলে তাদের এলাকায় গুটি নিয়ে যাওয়ার। নিজেদের এলাকায় গুটি নিয়ে কোনক্রমে লুকিয়ে ফেলতে পারলেই ওই এলাকার বিজয় মোটামুটি নিশ্চিত। গুটি খোঁজার সময় থাকে পরদিন সকাল পর্যন্ত। অন্য দলগুলো গুটির খোঁজ না পেলে যারা লুকিয়েছিলেন সকাল বেলায় তারা তা বের করেন। অতঃপর তাদের এলাকাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

একটু বেলা বাড়ার পর ঢাকঢোল পিটিয়ে বিজয়ী এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুটি দেখানো হয়। প্রচণ্ড আনন্দ-আহ্লাদ করা হয়। বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়। জয়ী এলাকার চেয়ারম্যান আনন্দে গরু জবাই দিয়ে ভুরি ভোজের আয়োজন করে। আনন্দ উৎসবের পর কমিটির কাছে গুটি হস্তান্তর করা হয়।

হুমগুটি খেলার যে আকর্ষণ ও উত্তেজনা তা এড়ানো যায় না। এ বিষয়ে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা খুব কঠিন! প্রায় তিনশত বছরের ঐতিহ্য বলে কথা। ফুলবাড়ীয়ায় মানুষ প্রতি বছর হুমগুটি খেলা আয়োজন করার মাধ্যমে এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছেন।

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

Scroll to Top