মাত্রিক আর্কিটেক্টস নিয়ে আমিনুল ইমনের যত ভাবনা – শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি

মাত্রিক আর্কিটেক্টস নিয়ে আমিনুল ইমনের যত ভাবনা – শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি

আমিনুল ইসলাম ইমন। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান স্থপতি। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থাপত্য অঙ্গনে দৃপ্ত পদাচারনা তার। দেশপ্রেম, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে স্থাপত্যশিল্পে এ দেশের জন্য সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে ডিজিটাল আর্কিটেকচার এর ওপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তার রয়েছে মাত্রিক আর্কিটেক্টস এবং মাত্রিক বিল্ডার্স নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। স্বনামধন্য এই স্থপতি অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে। বর্তমানে তিনি শান্ত মরিয়াম ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্য বিভাগের এবং ইন্টেরিয়র বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি’তে এই স্বনামধন্য স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

আমি প্রতিদিনই নতুন অনেক কিছু শিখছি। এই শেখার ধারা যতদিন বেঁচে আছি ধরে রাখার চেষ্টা করবো। একই সাথে যতটুকু শিখছি সে গুলো শুধু নিজের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ না করে এখন যেভাবে খন্ডকালীন শিক্ষকতা, স্থপতি ইনষ্টিটিউটের বিভিন্ন কমিটিতে কাজ ও লেখালেখির মাধ্যমে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি সেই ধারাটা অব্যাহত রাখতে চাই। ভবিষ্যতে নিজের কাজের পরিমান কমিয়ে এই চেষ্টাটা আরো বেশি করে করতে চাই। আমার চেষ্টায় জনসচেতনতা যদি খানিকটা বাড়ে এবং নগর গুলো যদি আরো খানিকটা বসতি বান্ধব হয় তাতেই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এ কথা গুলো বললেন স্বনামধন্য স্থপতি আমিনুল ইমন।
ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিটের মাঝে খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তার প্রতিটি স্থাপনায় থাকে সবুজের ছোঁয়া। প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজ প্রকৃতি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তিনি। স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। জন্ম রাজশাহীতে। বেড়ে ওঠা খুলনা ও ঢাকাতে। ইমনের বাবার নাম নূরুল ইসলাম শিক্ষক ছিলেন। মা আমাতুর রহমান ব্যাংকার ছিলেন। ইমন খুলনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৮৮ সালে। ১৯৯০ সালে খুলনা বিএম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। ১৯৯৭ সালে তিনি বুয়েট থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। স্থাপত্য বিভাগে পড়ার সময় থেকেই নিজে গড়ে তোলেন ‘মাত্রিক আর্কিটেক্টস’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে।
২০০২ সালে তিনি ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডিজিটাল আর্কিটেকচার’ এর ওপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পাস করার পর ২০০৩ সালে রয়েল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ (জওইঅ) আর্কিটেক্ট হিসেবে গবেষণা সেলে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তারপর তিনি ইউনিভার্সিটি অব লাফবরোতে রিসার্চচার হিসেবে যোগ দান করেন। একই সাথে লেইং কন্সট্রাকশন প্রতিষ্ঠানে রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ২০০৭ সালে দেশে ফিরে এসে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান ‘মাত্রিক আর্কিটেক্টস’ এর পরিচালনার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের স্থাপত্য বিষয়ক প্রধান পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন। ২০১০ সালে গড়ে তোলেন মাত্রিক বিল্ডার্স নামের আরও একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে আছেন।
তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে উত্তরায় শান্তমরিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস, কুড়িল বিশ্বরোডে আইকন টাওয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশীতে ভাষা শহীদ আবুল বরকত জাদুঘর, খুলনার গল্লামারীতে খুলনা কেন্দ্রীয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সৌধ, বারিধারা ডিপ্লোম্যাটিক জোনে আপন নিলয় কন্ডোমিনিয়াম, গাজীপুর মাওনাতে নাহি ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্স, দেশব্যাপী নতুন উপজেলা কমপ্লেক্স সমূহ, কুষ্টিয়ায় ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোবাকো রিসোর্ট, কুয়াকাটাতে এলকে এসএস এর রিসোর্ট, আফতাবনগরে দাসের কান্দি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, লালবাগে ইবনেসিনা হসপিটাল, ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে কেএফসি ভবন, বনানীতে প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেডের ওয়ার্ল্ড বিজনেস সেন্ট্রার, উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিস, অসংখ্য মিলনায়তন, অফিস ও ফ্যাকরী, সারা দেশ ব্যাপী উপজেলা কমপ্লেক্স, সারা দেশ ব্যাপী তিন শতাধিক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ, দেশের বিভিন্ন বিভাগে পুলিশের বিভিন্ন মডেল থানার ডিজাইন সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। এ ছাড়াও তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নানা কাজের সাথে যুক্ত থেকেছেন বাংলাদেশ আর্মিতে।
স্থাপত্য চর্চার পাশাপাশি শিক্ষকতাও চলছে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনও করেছেন। স্বনামধন্য এই স্থপতি দেশে আসার পর থেকেই বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পার্টটাইম শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করে আসছেন। আইএবি এর পক্ষ থেকে ইউআই এর বিভিন্ন কমিটিতে আন্তরাজাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করেছেন।
২০০২ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম নূরুননাহার চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য একজন কেক ডিজাইনার। এই দম্পতি দুই কন্যা সন্তানের জনক-জননী। বড় মেয়ে সুবাহ সানিডেল স্কুল থেকে এ লেভেল পাস করেছে। এমরিন সামার ফিল্ড স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে।
আমিনুল ইসলাম ইমন বলেন, স্থপতি হিসেবে প্রত্যেকটা প্রজেক্টকে শুধু কাজ না ভেবে আলাদা একটা করে গবেষণা হিসেবে বিবেচনা করি। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি প্রজেক্ট এর আলাদা স্থাপত্য চাহিদা থাকে। একই চাহিদার অনেক ধরনের সমাধান খুঁজতে হয়। তার মধ্যে থেকে সবচাইতে উপযোগী সমাধানটা খুঁজে বের করা খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ। প্রজেক্টটাকে তার এলাকার যে বুনন আছে তার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে হয় একই সাথে আবার নিজস্বতা বা ভিন্নতা আনতে হয়। আলো ও বাতাসের সুগম্যতা নিশ্চিত করতে হয়। ন্যূনতম কার্বন নিঃসরণের নিশ্চয়তা দিতে হয়। যথাসম্ভব সবুজায়ন দেওয়া, ছাদ ও টেরাসের মাধ্যমে খোলা প্রাঙ্গনের ব্যবস্থা করতে হয়। সর্বোপরি নির্মাণ জটিলতা এড়িয়ে কম খরচের ব্যাপার গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়। সেদিক দিয়ে একটা সুন্দর বিল্ডিং একজন প্রকৃত সুন্দর মানুষের মতো বলা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই শুধু দেখতে নয় কাজে এবং ব্যবহারেও সুন্দর হতে হয়। একই সাথে কখনো নিজেকে বিশেষ কোনো বিদেশি স্টাইলে আটকে না রেখে বরং মডার্ন ধারার সাথে দেশীয় আবহাওয়ার মিথস্ক্রিয়ায় এক ধরনের এই অঞ্চলের উপযোগী স্থাপত্য ধারা প্রচলনের যথাসম্ভব চেষ্টা করি। তরুণ স্থপতিরা যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ?
এই প্রশ্নের উত্তরে স্থপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, তরুণ স্থপতিরা যারা এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চাচ্ছেন তাদেরকে বলবো ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচটা বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে শিক্ষা জীবনে অনেক ঘাটতি থেকে যায়। এই সময়টা হচ্ছে সেই ঘাটতি পূরুণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। এই সময়টার পূর্ণ ব্যবহার করে নির্মাণ প্রক্রিয়া, ডিটেইন ড্রয়িং, ম্যাটেরিয়াল ইন্সটলেশনের পদ্ধতি, দেশ ও বিদেশের ভালো কাজ গুলো নিয়ে ক্রিটিক্যাল আলোচনা ইত্যাদির ব্যাপার গুলোর দিকে খুব গুরুত্ব দিতে হবে। ছোটখাটো ডিজাইন কাজকেও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে, নিজের মনোযোগের একশ ভাগ দিতে হবে এবং প্রতিদিন নিজেকে আগের দিনের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে শুরুটা করলে সাফল্য আসবেই।

সম্পর্কিত

Scroll to Top