এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলের শহর এল-ফাশের এখন এক ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্র। আধাসামরিক বাহিনী রেপিড সাপোর্ট ফোর্স বা আরএসএফ শহরটি দখল করার পর থেকে চলছে গণহত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ। জাতিসংঘ বলছে, শহরটিতে মাত্র কয়েক দিনে ১৫০০- জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, লাখো মানুষ পালিয়ে যাচ্ছেন মরুভূমির পথে। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই যুদ্ধ কেন শুরু হলো? কারা করছে এই হত্যাযজ্ঞ? এখানে আরব আমিরাতের ভূমিকা কী?
সুদান আফ্রিকার উত্তর-পূর্বে, লোহিত সাগরের তীরবর্তী একটি দেশ। ২০১৯ সালে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক ওমর আল-বশির জনগণের বিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর গঠিত হয় বেসামরিক ও সামরিক যৌথ সরকার, যার লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রে ফেরা। কিন্তু ২০২১ সালে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তার সহকারী মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমদতি) একসাথে সেই সরকার উৎখাত করেন। এই দুই সামরিক নেতা মিলে ক্ষমতা দখল করলেও, পরে তাদের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। কার হাতে থাকবে দেশের সেনাবাহিনী ও সোনার খনির নিয়ন্ত্রণ সেটিই হয়ে ওঠে সংঘাতের মূল কারণ।
লড়াইয়ের দুই পক্ষ
এই যুদ্ধের একদিকে আছেসুদানিজ আর্মড ফোর্সেস বা এসএএফ, যারা দেশটির প্রচলিত সেনাবাহিনী। এর নেতৃত্বে রয়েছেন জেনারেল বুরহান।
অন্যদিকে আছে আধাসামরিক বাহিনী রেপিড সাপোর্ট ফোর্স বা আরএসএফ — এরা মূলত দারফুর অঞ্চলের মিলিশিয়া যোদ্ধা থেকে গঠিত একটি শক্তিশালী বাহিনী, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সেই হেমদতি। আরএসএফ একসময় দারফুরে গণহত্যার জন্য কুখ্যাত জানজাওয়িদ বাহিনী থেকেই তৈরি। তাদের হাতে আছে প্রচুর অর্থ, আধুনিক অস্ত্র ও সোনার খনি থেকে আসা বিশাল সম্পদ। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে এই দুই বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে নামে। রাজধানী খার্তুমসহ দারফুর অঞ্চলজুড়ে শুরু হয় তীব্র সংঘর্ষ, যা এখন গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।
এল-ফাশের শহরে গণহত্যা
দারফুর অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর এল-ফাশের ছিল সেনাবাহিনীর শেষ শক্ত ঘাঁটি। ১৭ মাস অবরোধের পর, ২০২৫ সালের অক্টোবরে শহরটি দখল করে আরএসএফ। এরপরই শুরু হয় ভয়াবহ গণহত্যা। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী- শহরটিতে বেসামরিকদের গুলি করে হত্যা, নারীদের ওপর গণধর্ষণ, হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্রে আগুন দেয়া হচ্ছে। এমনকি রোগী ও শিশুর ওপর পর্যন্ত গুলি করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, শুধু সৌদি মাতৃসদন হাসপাতালে নিহত হয়েছেন ৪৬০ জনেরও বেশি মানুষ। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে— শহরের আশপাশে অসংখ্য গণকবর।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। যা জাতিসংঘের মতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুতি সংকট। খাদ্য, পানি, ওষুধ — কিছুই পর্যাপ্ত নেই। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, সহায়তা না বাড়ালে পরিস্থিতি পূর্ণাঙ্গ দুর্ভিক্ষে রূপ নেবে।
আরব আমিরাতের সম্পৃক্ততা
তবে এই যুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পৃক্ততা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বেশ কয়েকটি পশ্চিমা ও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে —সংযুক্ত আরব আমিরাত গোপনে আরএসএফকে অস্ত্র ও ড্রোন দিচ্ছে। চাদের আমদজারাস শহরে তাদের একটি ঘাঁটি থেকে এসব অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। কিন্তু কেন? কারণ হেমদতির আরএসএফ একসময় ইয়েমেন যুদ্ধে ইউএই’র পক্ষে ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়েছিল।
এছাড়া, সুদানের স্বর্ণের ব্যবসার বড় অংশ ইউএই-এর মাধ্যমে রপ্তানি হয়। যা যুদ্ধ অর্থায়নের বড় উৎস। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে মিসর ও সৌদি আরব। তাই সুদানের এই যুদ্ধ এখন একপ্রকার আঞ্চলিক ছায়াযুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধ এবং ভবিষ্যতের প্রশ্ন
এল-ফাশেরের পতনের পর দারফুরের বড় অংশ এখন আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে আবারও বিভক্তির পথে সুদান। জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন শান্তি আলোচনার আহ্বান জানালেও, দুই পক্ষই এখন ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়। আর এই টানাপোড়েনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। যাদের ঘরবাড়ি নেই, খাদ্য নেই, ভবিষ্যৎ নেই। সুদান এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ আর আন্তর্জাতিক উদাসীনতার এই চিত্র আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয় — যুদ্ধের আসল শিকার কখনও সেনাবাহিনী নয়, সাধারণ মানুষ।






