একটা সময় ছিল যখন প্রযুক্তি শিল্পের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ নেতারাও তরুণদের কোডিং শিখতে উৎসাহিত করতেন। তাদের বার্তা ছিল স্পষ্ট: কম্পিউটার সায়েন্সের একটি ডিগ্রি মানেই ছয় অঙ্কের বেতনের চাকরি এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই সোনালী দিনের অবসান ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। সিলিকন ভ্যালির কাছে বেড়ে ওঠা মানসী মিশ্রের গল্পটিই এর জলজ্যান্ত প্রমাণ।
সদ্যই পারডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক সম্পন্ন করা মানসী ভেবেছিলেন, তার জন্য প্রযুক্তির দুনিয়ায় সেরা সুযোগগুলো অপেক্ষা করছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি কোডিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এবং উচ্চ বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি তাকে এই বিষয়ে পড়তে আরও অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু এক বছর ধরে চাকরির জন্য আবেদন এবং ইন্টার্নশিপ খোঁজার পর তার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই গ্রীষ্মে নিজের টিকটক ভিডিওতে হতাশ মানসী বলেন, আমি কম্পিউটার সায়েন্সের ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হয়েছি, আর একমাত্র যে কোম্পানি আমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছে, সেটি হলো চিপোটেলে (একটি ফাস্ট-ফুড চেইন)। তার এই ভিডিওটি দ্রুত ভাইরাল হয় এবং ১ লাখ ৪৭ হাজারেরও বেশি মানুষ দেখেন, যা প্রযুক্তি খাতে নতুন গ্র্যাজুয়েটদের বর্তমান দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে।
বিগত দশকজুড়ে প্রযুক্তি সংস্থাগুলো কম্পিউটার সায়েন্সের স্নাতকদের জন্য লোভনীয় বেতন, স্টক অপশন এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল। এর ফলে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এই বিষয়টিকে তাদের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। মানসী মিশ্রের মতো অনেকেই প্রাথমিক থেকেই ওয়েবসাইট তৈরি করা এবং অ্যাডভান্সড কম্পিউটিংয়ের মতো কোর্স করে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। এর পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:
- ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই: অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা এবং অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের কারণে তারা এখন খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে নতুন নিয়োগের হারও অনেক কমে গেছে।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব: কোডিংয়ের জগতে এআই টুল বা কো-পাইলটের ব্যবহার বাড়ছে। এই টুলগুলো প্রোগ্রামারদের দ্রুত কোড লিখতে এবং ডিবাগ করতে সাহায্য করে। এর ফলে একজন প্রোগ্রামার এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে পারেন। ফলস্বরূপ কোম্পানিগুলো কম সংখ্যক জুনিয়র ডেভেলপার নিয়োগ দিয়েই তাদের কাজ চালিয়ে নিতে পারছে।
- বাজারের সম্পৃক্ততা: গত দশকে কম্পিউটার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
প্রযুক্তি শিল্পের এই পরিবর্তন নতুন স্নাতকদের এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যে শিক্ষার্থীরা লাখ ডলারের চাকরির স্বপ্ন দেখছিলেন, তারা এখন যেকোনো ধরনের চাকরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি সাময়িক নাও হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির সাথে সাথে প্রোগ্রামিং এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের ধরন বদলে যাবে। এখন শুধুমাত্র কোডিং জানাই যথেষ্ট নয়, বরং এর পাশাপাশি সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা এবং এআই টুলগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
মানসী মিশ্রের মতো হাজারও তরুণের গল্প প্রযুক্তি শিল্পের সেই সোনালী প্রতিশ্রুতির শেষের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একসময় যা ছিল নিশ্চিত ভবিষ্যতের চাবিকাঠি, সেই কম্পিউটার সায়েন্সের ডিগ্রি এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। উচ্চ বেতনের স্বপ্ন ভুলে অনেককেই এখন বিকল্প পথের সন্ধান করতে হচ্ছে, হোক তা চিপোটেলে বা অন্য ক্ষেত্রে।