স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ময়মনসিংহ শহরের ওমর কিউব – আনন্দ আলো

স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ময়মনসিংহ শহরের ওমর কিউব – আনন্দ আলো

মাসুদুর রহমান খান বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান স্থপতি। পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ( বুয়েট) এর স্থাপত্য বিদ্যায়। তাঁর রয়েছে “বসত আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ার্স” নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থাপত্য শিল্পচর্চাকে আপামর জনগণের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন সততা ও নিষ্ঠার সাথে। খ্যাতিমান এই স্থপতি দেশের জন্য বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা করেছেন। ঢাকা শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ২০০৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিউটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট এর সহ সভাপতি ছিলেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি তে এই খ্যাতিমান স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন-মোহাম্মদ তারেক

বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে মুক্ত চিন্তা, পেশার প্রতি অবিচল থেকে তিনি এদেশের স্থাপত্য শিল্পের সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন। খ্যাতিমান এই স্থপতির কাজের ধারাই হলো সার্বজনীনতা। অর্থাৎ সবার জন্য উন্মুক্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানকে জনসম্মুক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা। এই চেষ্টাই তাঁর কাজকে ভিন্নতা দিয়েছে। আর তাই মাসুদুর রহমান খানের প্রতিটি নকশাই হয়ে উঠেছে দর্শনীয় ও আকর্ষণীয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে মিরপুরে শেরে বাংলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, আগারগাওস্থ শেরেবাংলা নগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর সমাধি কমপ্লেক্স, কম্পিউটার কাউন্সিল ভবন , ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কার ও উন্নয়ন, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম,
পটুয়াখালীতে পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্টের মাস্টার প্ল্যান এবং অন্যান্য স্থাপনা, বিশেষ করে পায়রা পুনর্বাসন প্রকল্প, ওমেন স্পোর্টস কমপ্লেক্স, সুইমিংপুল অ্যান্ড জিমনেশিয়াম কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম ডিভিশনাল সুইমিং পুল, কুয়াকাটাতে রিসোর্ট হোটেল সী হ্যাভেন, সেগুনবাগিচায় জনস্বাস্থ্য ভবন, মানিকগঞ্জ ক্রিকেট স্টেডিয়াম কমপ্লেক্স, কক্সবাজার স্টেডিয়াম, গাজীপুর ইস্ট ওয়েস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য স্থাপনার নকশা করেছেন। দেশের বাইরেও তিনি ২টি প্রজেক্ট করেছেনÑ ভারতের গোয়াতে ‘গোয়া ইনডোর স্টেডিয়াম’, ‘গোয়া হকি স্টেডিয়াম’।
ইদানিংকালে ময়মনসিংহ শহরে নির্মিত ‘ওমর কিউব’ স্থাপনাটি সম্পর্কে স্থপতি মাসুদুর রহমান খান বলেন, ‘ওমর কিউব’ স্থাপনাটি একটি বাড়ি, যেটি একটি পরিবারের গল্প। বাবা হানিফ ওমর। একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। সংসারে দুই ভাই এক বোন। এই তিন ছেলে মেয়েকে অল্প বয়সে রেখে বাবা মারা গিয়েছিল। বর্তমানে দুই ভাই পরিবারের কর্ণধার। মা একজন আদর্শ গৃহিণী। তিনজন ছেলে মেয়েকে অত্যন্ত যন্ত সহকারে লালন পালন করেছেন। বোন দেশের বাইরে থাকেন, মাঝে মাঝে দেশে আসেন। তাদের এই তিন ভাই বোনের মধ্যে একটি সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে। একেক জনের তিনটি করে ছেলে মেয়ে।
দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতা-এই তিন বাহু সমান সমান হলে যে উচ্চতা ধারণ করে সেটাই কিউব। এই পরিবারের সংখ্যা অলৌকিকভাবে ‘তিন’ এর গুণিতক। যে কারণে তিনটি সমান অক্ষরকে (x.y.z) স্থাপতিক আকার বিবেচনা করে। পরিবারের পূর্বপুরুষ ওমরের নাম মিলে স্থাপনাটির নামকরণ করা হয় ‘ওমর কিউব’। বাড়িটির নকশার পাশাপাশি এই নাম করণটিও স্থাপত্য ডিজাইনের অংশ হিসেবে স্থপতির দেয়া।
ডিজাইন কনসেপ্ট: নামকরণের পাশাপাশি পুরো বাড়িটিকে একটি কিউব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারপর ব্যবহারিক বিবেচনা, অবস্থান ও আবহাওয়াগত বিষয়টিকে মাথায় রেখে বিভিন্ন ব্যবহারিক জায়গা গুলো বসানোর ক্ষেত্রে দেয়াল ও খোলা জায়গা গুলো বিবেচনা করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় নান্দনিক বিষয়টিও পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৃহত্তম মূল কিউবটির চার ধারে ছোট ছোট কিউবের ন্যায় বেলকনি গুলি জড়িয়ে আছে, যেগুলো আগামী প্রজন্মের ধারণা থেকে এসেছে। পরিবারের উক্ত প্রারম্ভিক গল্পটিকে মূল বিবেচনায় নিয়ে, স্থাপত্য শিক্ষার একটি মৌলিক ব্যাকরণ ‘ফর্ম ফলোজ ফাংশান’ এর এই দর্শনটি আমাদের ডিজাইনে যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে।


সম্পর্কিত

Shaha-cement
স্থপতি মাসুদুর রহমান খান

এরকম একটি একান্নবর্তী পরিবার বাড়িতে, আমাদের দেশের ঐতিহ্যগত পুরনো গ্রামের বাড়ির পরিসর বিন্যাসটি অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে আমাদের গ্রামের পর্যাপ্ত জায়গা থাকার কারণে এই স্পেস গুলোকে হরিরজনটালি বিভক্ত করা হতো, এই একই বিষয়টা মনে রেখে, জায়গা সীমাবদ্ধতার কারণে ওই একই পরিসরের বিন্যাস ভার্টিকালি করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনটি অংশে ভাগ থাকতো। যেমন- ১. বাহির উঠান (যেটার সঙ্গে গরু ঘর, বৈঠক, পুকুর ইত্যাদি সংযুক্ত থাকতো)। ২. ভিতরের উঠান (যেটাকে কেন্দ্র করে পরিবারগুলো থাকতো)। ৩. বাড়ির পিছন (যেখান থেকে দূরের জমি, নদী ইত্যাদি দেখা যেত)
ডিজাইন বর্ণনা:
ময়মনসিংহ শহরে পুরনো অংশের প্রাণ কেন্দ্রে অত্যন্ত ঘনবসতি এলাকায় একমাত্র প্রবেশের রাস্তাটি বাড়ির প্রধান ফটকের পর ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে যায়। যে কারণে বাড়িতে প্রবেশ ও বাহিরের সুবিধার্থে রাস্তা হতে কিছুটা জায়গা ছেড়ে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে প্রধান ফটকটি স্থাপন করা হয়। ফটকের ডিজাইনে বাড়ির নামফলক ও গেইট লাইটটি মূল ভবন ডিজাইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য দেখে তৈরি করা হয়। পরিবারের তিন-চারটি গাড়ি সহ অতিথিদের গাড়ি রাখার জন্য রাস্তা হতে ২- ৬ ফিট নিচে সেমি বেজমেন্ট ফ্লোরটি করা হয়।যেখানে গাড়ির পার্কিংয়ের পাশাপাশি ড্রাইভার কেয়ারটেকারদের থাকার স্থান, পাম্প রুম, জেনারেটর, স্টোর ইত্যাদি বসানো হয়। আর পায়ে হাঁটার প্রবেশ পথটি ৮- ৬ ফিট উপরে পুরো বাড়ি ভিটা টিকে উপরে তুলে আনা হয়। যা মূলত বাড়ির আউটডোর উঠান হিসাবে চিন্তা করা হয়, যার চার পাশে সবুজ ঘাস ও গাছপালা দিয়ে খোলামেলা রাখা হয়। যার পেছনের দিকে অনেকটা প্রাচীন বাড়ির পুকুরের মতো তৈরি করা হয়েছে একটি সুইমিং পুল। সাইটের সীমাবদ্ধতার কারণে স্বল্প জায়গার ভিতরে আমাদের গ্রামীণ বাড়ির ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে গাছপালা, বাগান, উঠান, পুকুর ইত্যাদিকে সংযোজন করে বাড়ির নিচতলাটিকে বাড়ির বাহিরের অংশ হিসেবে চিন্তা করা হয়, যেখানে আগত অতিথি ও পরিবারের মানুষের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত থাকবে।
পরিবারের প্রধান দুই ভাই পেশায় ব্যবসায়ী। এক ভাই রাজনীতি চর্চায় আগ্রহী সেই দিকটা বিবেচনায় রেখে আগত সাধারণ মানুষের জন্য স্বতন্ত্র লোহার তৈরি খোলা গোলাকার সিঁড়ি বসানো হয়েছে।
ভার্টিকালি বাড়িটিকে ব্যবহারিক পার্থক্যের বিবেচনায় মূলত স্পষ্ট তিনটি অংশে ভাগ করা যাবে।
১. নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার অংশ:
উন্মুক্ত সিঁড়ি দিয়ে রাস্তা হতে ৮-৬ ফিট উঁচুতে ভবনটির মূল ভিটা যার সঙ্গে মাঝখানে একটি খোলা ভয়েড দিয়ে ২য় তোলার সঙ্গে সংযুক্ত অংশ এটি। আগত বাইরের অতিথিদের জন্য, যেখানে দুই ভাইয়ের অফিস কক্ষসহ ২টি গেস্ট বেড ও ছোট্ট কিচেন সহ ডাইনিং রয়েছে। এই অংশ পরিবারের লোকদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই অর্থাৎ পুরো এলাকাটি পারিবারিক অংশের বাইরে। এটিকে আমাদের ঐতিহ্যগত পুরনো গ্রামের বাড়ির বাহির উঠানের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
২. তৃতীয় চতুর্থ ও পঞ্চম তলা:
একটি সম্পূর্ণভাবে পারিবারিক অংশ যেখানে তৃতীয় তলাটিকে পারিবারিক অতিথিদের মেইন লিভিং, ডাইনিং, কিচেন ও সাহায্যকারী মেয়েদের বেডরুম অবস্থিত। চতুর্থ ও পঞ্চম তলা দুটি চাহিদা অনুযায়ী দুই ভাইয়ের পরিবারের জন্য আলাদাভাবে তৈরি করা, যেখানে প্রত্যেকেই মা ও বোনের জন্য আলাদাভাবে রুম রয়েছে। এই তিনটি ফ্লোর ভার্টিক্যালি অবস্থিত হলেও একটি খোলা চারকোনা উন্মুক্ত পরিসরটি একটি খোলা লোহার সিঁড়ির মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনটি ফ্লোর একটি উন্মুক্ত ভয়েডের দ্বারা সংযুক্ত। যা আমাদের প্রাচীন গ্রামের বাড়ি অভ্যন্তরীণ উঠানোর ন্যায় ব্যবহৃত হবে।
৩. ছাদের অংশ:
এই অংশটি বাড়ির মূল চাহিদার বাইরে, শারীরিক শান্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন ও ব্যবহারিক বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কেননা একটি বাড়ি শুধু থাকা- খাওয়ার জায়গা হবে না, এটা হবে আগামী প্রজন্মের স্বপ্নের বীজতলা। ছাদটিকে ভার্টিকালি দুইটি অংশে বিস্তৃত করা হয়েছে। এক্ষেত্র পারিবারিক অংশ ও বহিরাগতদের অংশ বিষয় হিসাবে ভাগ করার পাশাপাশি অদূরে অবস্থিত শহরের মূল আকর্ষণ বহমান ব্রহ্মপুত্র নদীটির দৃশ্য উপভোগ করার বিষয়টি মাথা রাখা হয়।
nirmane ami Logoবাড়ির পুরো পশ্চিম অংশটিতে লিফট ও সিঁড়ি এমনভাবে একটি সলিড দেয়াল ও সর্বোচ্চ ছাদটিকে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা নান্দনিকতার পাশাপাশি পশ্চিম দিকের প্রচণ্ড সূর্যের তাপ থেকে পুরো বাড়িটিকে অনেকটা ছাতার নয় ঢেকে রাখবে। আমাদের দেশের আবহাওয়ার বিবেচনায় এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চার ধারে অগণিত বাড়িগুলো হতে প্রাইভেসি রক্ষার জন্য রুমে বেলকোনি গুলোকে চারধারে সলিড ওয়ালের কিউবিক্যাল আকৃতি করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রাইভেসি বিবেচনা ভার্টিক্যাল লুভার ব্যবহার করা হয়েছে। বর্গাকৃতির বারান্দাগুলো ব্যবহারিক এর পাশাপাশি মূল কনসেপ্ট কিউবিক্যাল বাড়ির নান্দনিক বিষয়টিকেও প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। একটি বাড়ি শুধুমাত্র গতানুগতিক থাকা খাওয়ার স্থান নয়, স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা রেখে খেলাধুলা, সাঁতার ও বিভিন্ন অংশ প্রতিনিয়ত হাঁটা চলার জন্য পর্যাপ্ত পরিসর রাখা হয়েছে। আলো বাতাসের দিকটিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে বেডরুম সহ ব্যবহৃত স্থানগুলোকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও আরামের পাশাপাশি বাড়িতে বসবাসকারী ছেলে মেয়েদের ভিতরে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন তৈরি হবে, ডিজাইন এই বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্লায়েন্টের চাহিদা, প্রকল্পের অবস্থান, দেশের আবহাওয়া ও দেশীয় নির্মাণ পদ্ধতি বিবেচনায় রেখে বসবাস এর উপযোগী, আরামদায়ক ও নান্দনিক পরিসর তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রকল্পে।

Scroll to Top