ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: ময়লা-দুর্গন্ধে বিপর্যস্ত রোগী ও স্বাস্থ্যসেবা

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: ময়লা-দুর্গন্ধে বিপর্যস্ত রোগী ও স্বাস্থ্যসেবা

সিলেট: সিলেটের কোটি মানুষের একমাত্র ভরসা এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য— এই গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটি এখন নিজেই ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যেখানে সুস্থতার প্রথম শর্ত, সেখানেই হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ময়লার স্তূপ। এ যেন ভয়ংকর রুগ্ন দশা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিত্র ভয়াবহ। প্রতিটি ওয়ার্ডে ময়লার স্তূপ এবং খাবারের উচ্ছিষ্টের তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যে রোগী, রোগীর স্বজন, চিকিৎসক ও নার্সসহ সবাই অবস্থান করছেন। রোগীদের শয্যার পাশেই ময়লার স্তূপের উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত যেন সবাই আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকির। যা জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড থেকে শুরু করে সার্জারি কিংবা মেডিসিন ওয়ার্ড—প্রতিটিরই নাজেহাল অবস্থা। ময়লার তীব্র দুর্গন্ধে রোগী ও তার স্বজনরা এক মুহূর্তও ঘুমাতে পারছেন না, ফলে নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের। শুধু তাই নয়, রোগীদের সঙ্গে থাকা স্বজনরাও হাসপাতালে এসে এখন নিজেরাই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন। এই পরিস্থিতি দ্রুত সমাধানের দাবি জানাচ্ছে ভুক্তভোগীরা।

হাসপাতালের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের শিশু বিভাগের চিত্র ভয়াবহ। ওয়ার্ডে প্রবেশ করতেই বিশেষ করে শৌচাগারের সম্মুখভাগে দীর্ঘদিন ধরে প্লাস্টিকের ড্রামে বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছে।

শুধু ওয়ার্ডের ভেতরেই নয়, হাসপাতালের চারপাশেই ব্যবহৃত ইনজেকশনের অ্যাম্পুল, অপারেশনে ব্যবহৃত গজ-তুলাসহ অন্যান্য চিকিৎসা বর্জ্য যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও যেন দেখার কেউ নেই।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা সারাবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। তাদের ভাষ্যমতে, হাসপাতালে ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসার অবস্থা। হাসপাতালের নোংরা পরিবেশে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তারা। এই পরিস্থিতি রোগীদের দ্রুত আরোগ্য লাভের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জকিগঞ্জের আটগ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রফিক উদ্দিন (৫৫) সারাবাংলাকে জানান, ‘এখানে সুস্থ কোনো মানুষ দুই মিনিটও টিকে থাকতে পারবে না। আমরা নিরুপায় হয়েই এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি।’ আমরা গরিব মানুষ, প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে এখনই এখান থেকে চলে যেতাম।’

নবীগঞ্জের বাংলাবাজার থেকে রোগীর সঙ্গে আসা সুফিয়া বেগম (৪৫) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘হাসপাতালের টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। রোগীকে সুস্থ করতে এসে এখন আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’

তিনি আরও জানান, ‘এখানে বাধ্য হয়ে আমরা জনপ্রতি ১০ টাকা করে চাঁদা তুলে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দিয়ে টয়টেল পরিষ্কার করাচ্ছি। আমাদের আর কোনো উপায় নেই।’

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক, ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী, হাসপাতালের এমন নোংরা পরিবেশের জন্য জনবল সংকটকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘সিলেটের একমাত্র ৫০০ শয্যার হাসপাতাল এটি। এখানে যে পরিমাণ জনবল থাকা উচিত, তার থেকে ২৫ ভাগ কম জনবল নিয়ে আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’

ডা. চক্রবর্তী আরও উল্লেখ করেন, “রোগীর চাহিদার সঙ্গে জনবলের বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য নিয়েই আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

প্রসঙ্গত, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে নোংরা পরিবেশ, রোগীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, সেবার অনিয়ম, এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও বহুবার এমন অভিযোগ গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বারবার এসব ঘটনা সামনে এলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

Scroll to Top