দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল বিভাগের একমাত্র ভিআইপি ও মর্যাদার বরিশাল-৫ (সদর) আসনে প্রতীক বরাদ্দ পেয়েছেন ছয়জন প্রার্থী। বিভাগীয় শহরের এ আসনে এখন পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে দেখা মিলেছে শুধুমাত্র নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের দুইজন প্রার্থীকে। অন্য চারজন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের এখন পর্যন্ত মাঠে দেখা মেলেনি।
সূত্রমতে, গত ১৮ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হয়ে প্রতীক গ্রহণ করেছেন ছয়জন প্রার্থী। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম নৌকা, জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস লাঙ্গল, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আলহাজ। মোঃ সালাহ উদ্দিন রিপন পেয়েছেন ট্রাক, এনপিপির আবদুল হান্নান আম, বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টির মাহাতাব হোসেন ডাব, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী মোঃ আসাদুজ্জামান ছড়ি প্রতীক পেয়েছেন। এ ছাড়া দ্বৈত্য নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগে স্বতন্ত্র আরেক প্রার্থী বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর প্রার্থিতা ঝুলে রয়েছে। এ ব্যাপারে দায়ের করা আপিলের শুনানী আগামী ২ জানুয়ারি। ওইদিন জানা যাবে তিনি (সাদিক) নির্বাচন করতে পারবেন কিনা।
সূত্রে আরও জানা গেছে, এ আসনে ইতিমধ্যে নৌকা ও ট্রাকের পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ এবং উঠান বৈঠক সবার দৃষ্টি কাড়লেও লাঙ্গল, আম, ডাব ও ছড়ি প্রতীকের প্রার্থী কিংবা তাদের কোনো কর্মী সমর্থকদের প্রচার প্রচারণায় দেখা যায়নি। এমনকি মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কোন নেতৃবৃন্দকে নৌকার পক্ষেও মাঠে দেখা মেলেনি।
এ ব্যাপারে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাগাভাগির এই নির্বাচন আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। যেখানে ভোটের আগেই আসন ভাগ করে আওয়ামী লীগ তাদের মনোনীত প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে, তাতেই স্পষ্ট হয় যে ফলাফল নির্ধারিত।’
আর ছড়ি প্রতীকের প্রার্থী মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, আমার পক্ষে লিফলেট বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আম ও ডাব মার্কার প্রার্থীরা এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। গত ২৩ ডিসেম্বর বরিশালের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও নির্বাচন কমিশনের সচিব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বরিশালের ছয় আসনের প্রার্থীদের সাথে বৈঠক করেছেন। এ সময় সদর আসনের ছড়ি ও ট্রাক মার্কার প্রার্থীদের দেখা গেলেও আর কোনো প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন না। ওই বৈঠকে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহ উদ্দিন রিপন তার নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে বাঁধা দেওয়ার অভিযোগ করেন। এ আসনে অনেক প্রার্থীদের কোনো প্রচার প্রচারণা নেই, তারা প্রতীক নিয়ে বসে আছেন জানালে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভোটারদের উপস্থিতি। আর এই ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার দায়িত্ব প্রার্থীদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ আসনের নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীমের সহধর্মীনির মৃত্যুতে প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে তার বিশাল কর্মী সমর্থক এবং সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের সহধর্মীনি লুনা আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে দিনরাত সমানতালে গণসংযোগ, প্রচার-প্রচারনা ও উঠান বৈঠক অব্যাহত রয়েছে। নৌকা মার্কার প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোঃ মাহমুদুল হক খান মামুন বলেন, শোককে শক্তিতে পরিণত করে আগামী ২/১ দিনের মধ্যে নৌকার প্রার্থী পূর্ণরায় নির্বাচনী মাঠে নামবেন। একইসাথে আগামী ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর বরিশাল সফরকে শতভাগ সফল করতে মাঠে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন।
নৌকার প্রার্থীর একাধিক কর্মীরা অভিযোগ করেন, সাদিক আব্দুল্লাহ প্রার্থী হতে না পারলে তার কর্মী-সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন রিপনের ট্রাকে ওঠার আভাস মিলেছে। যে কারণে অদ্যবর্ধি মহানগর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সাদিক অনুসারি নেতাকর্মীরা নৌকার পক্ষে মাঠে নামেননি। তবে শেষপর্যন্ত উন্নয়নের পক্ষে বরিশাল সদর আসনের সর্বস্তরের ভোটাররা নৌকা মার্কার ওপরই আস্থা রাখবেন। আগামী ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরিশাল সফরের মধ্য দিয়ে যার প্রতিফলন ঘটবে বলেও তারা উল্লেখ করেন।
অপরদিকে ভারতের চেন্নাইর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যুর দিন বিকেলে বরিশাল সদর উপজেলার সাহেবের হাট এলাকায় অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, আমি আমার স্ত্রীর লাশ নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। তাই তাকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। সকলের কাছে মরহুমা স্ত্রীর জন্য দোয়া চেয়ে তিনি আরও বলেন, এত কষ্টের মাঝেও আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আপনাদের সাথে যদি কথা না বলি, তাহলে প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা সঠিকভাবে পালন করা হবেনা। তিনি বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী একের অধিক হতে পারে, অন্যদল থেকেও হতে পারে। সেটা নিয়ে চিন্তা নেই। আমি জনগনের ওপর নির্ভরশীল। বিগত পাঁচবছরের মূল্যায়ন করে জনগণ যদি আমাকে ভোট দেয় তাহলে আমি নির্বাচিত হব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে কাজ করবো।
জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, প্রার্থীদের মূল্যায়ন করবে জনগণ, তারা জানে কাকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। গত পাঁচ বছরে বরিশালবাসী বুঝতে পেরেছে কে নির্ভরশীল ব্যক্তি আর কার ওপরে আস্থা রাখা যায়। তারা জানে কার ওপর আস্থা রাখলে বরিশালের উন্নয়ন করা যায়।
তিনি আরও বলেন, বরিশালবাসী আমার প্রতি যে ভালোবাসা ও বিশ্বাস দেখিয়েছেন, সেই বিশ্বাস ও ভালোবাসায় আস্থা রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে পুনরায় বরিশাল-৫ আসনের মানুষের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি কথা দিচ্ছি, যদি বিজয়ী হয়ে আসতে পারি তাহলে করোনাকালীন সংকট সময়ে যেসব কাজ করা সম্ভব হয়নি, সেগুলোসহ চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবো।
আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য বরিশালের কৃতী সন্তান অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যার হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দিয়েছেন, সে যেই হোক না কেন, তাকে বিজয়ী করতে দলের সবাইকে একযোগ হয়ে কাজ করতে হবে। বলরাম পোদ্দার আরও বলেন, যারা প্রধানমন্ত্রীকে মনেপ্রাণে ভালবাসেন তাদের নৌকার বিপক্ষে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দলের পদ-পদবীধারী যারা নৌকার বিপক্ষে যাবেন, তারা প্রধানমন্ত্রীকে শুধু মুখে মুখে ভালবাসেন এমনটাই ধরে নেওয়া হবে।
অপরদিকে বরিশাল-৫ সদর আসনের প্রচারণার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, নৌকার পক্ষে যারা মাঠে সরব রয়েছেন তারা সবাই সদর আসনের বর্তমান সাংসদ ও পানিসম্পদ মন্ত্রী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীমের ঘনিষ্ঠজন। সেইসাথে সাদিক আব্দুল্লাহর একমাত্র চাচা ও বর্তমান সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত এবং সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণের অনুসারীরাও রয়েছেন নৌকা মার্কার প্রচার-প্রচারনায়। অপরদিকে প্রচরণার মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ট্রাক মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ সালাহ উদ্দিন রিপন। নৌকার মনোনয়ন বঞ্চিত এই প্রার্থী দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে তিনি বিজয়ী হবেন। সচেতন বরিশালবাসীর মতে, সাদিক আব্দুল্লাহ নির্বাচনের মাঠে শেষপর্যন্ত না থাকতে পারলে তার সমর্থনটা ট্রাক মার্কার এই প্রার্থীর ওপরই ভর করতে পারে। তবে এ বিষয়ে কোনো প্রার্থী মন্তব্য করেননি।
১৯৭৩ থেকে ২০১৮ এর নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলছে, বরিশাল-৫ (সদর) আসন থেকে ১৯৯১ ও ২০১৪ সালের উপনির্বাচন ছাড়া বিএনপি সাতবার, আওয়ামী লীগ তিনবার ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী একবার বিজয়ী হয়েছে। সেই হিসেবে বিএনপির সমর্থকদের ভোট একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি ট্রাক মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহ উদ্দিন রিপন দীর্ঘবছর ধরে বরিশালে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ট্রাস্টের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে পাশে রয়েছেন। সেইসব হিসেব মিলিয়ে নির্বাচনের মাঠে ভোটারদের বাগে আনতে ট্রাক মার্কার সমর্থকরা কাজ করছেন। নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল জেলার ছয়টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভোটার সংখ্যা মহানগর ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৫ আসনে। এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৯ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৩২ হাজার ৯১১ জন এবং হিজড়া ভোটার তিনজন।