দেশে ক্যান্সারে প্রতিবছর মৃত্যু লাখের বেশি, নিরাময় ওষুধের প্রাপ্যতা বেড়েছে

দেশে ক্যান্সারে প্রতিবছর মৃত্যু লাখের বেশি, নিরাময় ওষুধের প্রাপ্যতা বেড়েছে

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

মানব শরীরের অন্যতম জটিল রোগ হলো ক্যান্সার। বলা হয়, এই মরণঘাতক রোগের চিকিৎসা সময়মতো করাতে না পারলে আক্রান্ত রুগীর মৃত্যু অনেকটাই অণিবার্য।

একসময় ক্যান্সারের নাম শুনলেই সবাই ভয়ে আতকে উঠতেন। এর প্রধানতম কারণ ছিল অসাধ্য চিকিৎসা এবং দেশে ক্যান্সারের ওষুধের সহজলভ্যতা বা প্রাপ্যতা না থাকা।

একই সাথে দেশের বাইরে থেকে ভিন্ন পথে আসা ক্যান্সারের ওষুধের অতিরিক্ত দাম বা উচ্চমূল্য। ফলে ক্যান্সারের চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধের জন্য প্রতিবেশী বা বাইরের দেশের দিকে সবসময় তাকিয়ে থাকতে হতো। কিন্তু সময় বদলে গেছে।

দেশের শীর্ষ ওষুধ প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ক্যান্সারের অমূল্য সব ঔষধ দেশেই উৎপাদন করছে। দেশের অভ্যন্তরে ক্যান্সার রোগের ওষুধ সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য হওয়ার কারণে এখন আর কাউকে প্রতিবেশী দেশ বা ল্যাাগেজ পার্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে না। এমন কী গোপনে অধিক টাকা দিয়েও কোনো বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয় না।

ওষুধ প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক এবং সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত উদ্যোগের কারণে ক্যান্সার নিয়ে যে বিশাল ভীতি ছিল তা অনেকটাই কমে এসেছে। দেশের অভ্যন্তরেই ক্যান্সার প্রতিরোধে স্বল্পদামে নতুন নতুন ওষুধ তৈরি হওয়ার কারণে মানুষের মাঝে আস্থা ও স্বস্তি দুইই বেড়েছে।

প্রথমত, দেশে উৎপাদিত ওষুধগুলোর উচ্চমান বিদেশেও প্রশংসিত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ক্যান্সারের ওষুধ সুলভ মূল্যে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্যান্সার সাপোর্টিভ কেয়ারের একটি অত্যবশ্যকীয় ওষুধ পেগফিলগ্রাসটিম এক সময় ৪০ হাজার টাকার উপরে দাম ছিল, এখন এই ওষুধ ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় সুলভ মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য কেমোথেরাপির ওষুধগুলোও দেশে তৈরি হচ্ছে এবং এর মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে। এতে করে রোগীরা এখন ওষুধের উচ্চমূল্যের জন্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না।

ক্যানসার
ক্যান্সার, একটি অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধিজনিত রোগ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। বছরে ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সেরা চিকিৎসা ইমিউনোথেরাপি একসময় বাংলাদেশে সহজলভ্য ছিল না।

দেশের বাইরে গিয়ে এই চিকিৎসা নিতে হতো। খরচও হতো অনেক বেশি। কিন্তু দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো এই ওষুধ দেশেই উৎপাদন ও সহজলভ্য করে নতুন এক দিগন্তের সূচনা করেছে।

একসময় এসব কল্পনার বাইরে থাকলেও ওষুধ কোম্পানিগুলো এসব জয় করতে সক্ষম হয়েছে। লাখ টাকার বদলে ইমিউনোথেরাপি এখন ৬০ হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। হাতের নাগালে না থাকার কারণে একসময় এসব ওষুধের জন্য আক্রান্ত রুগীদের প্রচুর অস্বস্তিকর সময় ব্যয় করতে হয়েছে। দেশের দুই শীর্ষ ওষুধ প্রস্তত কোম্পানি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এবং বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস এই ধরনের ওষুধ অনেক কম দামে বাজারে এনেছে।

ইনসেপ্টা, বীকন, জিসকা, হেলথকেয়ারসহ দেশের বিশেষায়িত কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি ক্যান্সার নিরাময়ে বেশিরভাগ জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করছে। দেশে উৎপাদিত এই ওষুধগুলোর দামও তুলনামূলক কম। আবার এসব ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন বা প্রটোকল সঠিকভাবে মানা হয়।

ক্যান্সার আক্রান্ত রুগীর চিকিৎসায় ওষুধের প্রাপ্যতা যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় আক্রান্ত রুগীদের মাঝে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতাও অনেক কমে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে মিডিয়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেছেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, আমাদের বাংলাদেশেই বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা রয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় বিভিন্ন মডালিটির মধ্যে সার্জারিটাই বেশি ফলপ্রসু।’

এরপর আছে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, অ্যান্টিবডি ট্রিটমেন্ট ও ইমিউনোথেরাপি। তবে অনেক ক্ষেত্রে কিছুই লাগে না, শুধু হরমোন চিকিৎসাতেই ভালো ফল হয়।
ক্যানসার-চিনি
বিশ্বে যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তার ১২ ভাগ হয় ক্যান্সারের কারণে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ক্যান্সারকে যথাক্রমে মৃত্যুর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ক্যান্সার হলে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চারপাশের টিস্যু এমনকি দূরবর্তী কোনো অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

পরিণতিতে আক্রান্ত ব্যক্তি একপর্যায়ে মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে আমাদের দেশে স্তন, জরায়ু, অন্ত্রনালি, প্রোস্টেট, ফুসফুস, পাকস্থলী, ডিম্বাশয়, যকৃৎ, অন্ননালি, মুখগহব্বর , ত্বকে ক্যান্সার আক্রান্ত হন। দেশে প্রায় ৪০ ভাগ ক্যান্সারের প্রধান কারণ ধুমপান। ধুমপানের প্রভাবে ফুসফুস, মুখগহব্বর , খাদ্যনালী, প্যানক্রিয়াস, কিডনি, মূত্রথলির, পাকস্থলী ক্যান্সারও হয়ে থাকে।

এছাড়া অ্যালকোহল মুখের ক্যান্সার, লিভারের ক্যান্সার, পরিপাকতন্ত্রের ক্যান্সার এবং কিডনির ক্যান্সার ঘটাতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার, হেপাটোবিলিয়ারি ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কেউ কেউ মাংস জাতীয় খাবার বা চর্বিযুক্ত মাংস বেশি খাওয়ার কারণে ক্যান্সার ঝুঁকিতে থাকেন।

ক্যান্সারের কারণ হিসেবে পান-সুপারি, জর্দা, তামাকপাতা, ধূমপান, মদ্যপান, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শ, কিছু কিছু ভাইরাস ( হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি, এবস্টেইন বার ভাইরাস, সাইটোমেগালো ভাইরাস), কিছু পরজীবী (সিস্টোসোমিয়াসিস), সূর্যকিরণ, তেজস্ক্রিয়তা, কীটনাশক, রঙিন খাবার, বায়ুদূষণ প্রভৃতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ক্যান্সার চিকিৎসার কয়েকটি পর্ব বা অংশ রয়েছে। এরমধ্যে সার্জারী, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোনথেরাপি এবং টারগেটেড থেরাপি প্রধান। কিন্তুএ র পরের অংশটি অনেক গুরুত্বপুর্ণ আর তাহলো ক্যান্সারের চিকিৎসকের কাছে আজীবন ফলোআপ।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে এই কাজটি কাউকেই ঠিকমত করতে দেখা যায় না। নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে চিকিৎসা পরবর্তি কালে ক্যান্সারের পুনরাবির্ভাব শুরুতেই নির্নয় করা যায়, এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেয়া যায়। ফলে রোগী দীর্ঘদিন সুস্থ ভাবে জীবন যাপন করতে পারে।

Scroll to Top