আধুনিক স্থাপত্যশিল্পে টেনসাইল নিয়ে সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন স্থপতি লতিফা সুলতানা। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে তিনি সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে তিনি শিক্ষার্থীদেরকে স্থাপত্যের নানা বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি জার্মানির এনহেল্ট ইউনির্ভাসিটি থেকে ঞবহংরষব ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর স্থাপত্য বিভাগে কসবার ওপরে পিএইচডি করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি উক্ত বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রকাশনার সাথে যুক্ত আছেন। স্থাপত্যচর্চাও চলছে নিয়মিত। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
আমাদের এখানকার ইকো সিস্টেম এতটাই ডিজাইন উপযোগী যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে পাস করে বের হওয়া স্থপতিদের ডিজাইন করতে তেমন বেগ পেতে হয় না। এখানকার ডিজাইনই যেন প্রকৃতি প্রদত্ত। তাই এখানে কাজ করাটা স্থপতিদের জন্য সহজ। তবে কাজের ব্যাপারে স্থপতিদের সহজেই কম্প্রোমাইজ করা উচিত নয়, দৃঢ় হতে হবে। স্থপতিরা তাঁদের কাজ নিয়ম মেনে যথাযথভাবে করবে, এ বিশ্বাসটা তাদের ভেতর জাগিয়ে তুলতে হবে। এশহরকে সুরক্ষিত রাখতে এর বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। অল্প পরিসরে হলেও এ কাজ শুরু হয়েছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পূর্বাচল। শহরকে রক্ষায় এ ধরনের কাজ হচ্ছে, তবে আমরা সর্বক্ষেত্রে নিয়মটা মানতে চাই না। কেননা এখানে আইনের প্রয়োগ কম। এই প্রয়োগটা সঠিক হলে সবকিছুই ঠিকঠাক চলত। এটি কার্যকর করা গেলে সুন্দর সমৃদ্ধ আগামীর এক শহর আমরা পেতে পারি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কথা গুলো বললেন স্থপতি লতিফা সুলতানা।
তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়। কিন্তু জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবার নাম এম এ লতিফ ও মা কোহিনুর বেগম দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। দুই ভাই বোনের মধ্যে লতিফা সুলতানা বড়। ছোট ভাই রাইসুল কবির ‘ব্রেন স্টেশন’ প্রতিষ্ঠানের সিইও।
হলিক্রস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ১৯৯৭ সালে এসএসসি ও ১৯৯৯ সালে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০০৬ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাশ করে বের হওয়ার পরই তিনি যোগ দেন ‘ডি ডব্লিউ এম ফোর’ ফার্মে। সেখানে দুই বছর কাজ করেন। এরপর মালয়েশিয়ার অধীনে ইন্সপ্রেশনে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ওপর শিক্ষকতা করেন তিন বছর। ২০১১ সালে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সহকারি অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালে জার্মানির এনহেল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ঞবহংরষব এর ওপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। শিক্ষকতা ও স্থাপত্য পেশার সাথে দীর্ঘ দিন ধরে যুক্ত আছেন। ২০০৭ সালে স্থপতি লতিফা সুলতানা স্বামী প্রকৌশলী মো: শাহজাহান মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ডি সেফ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। দুজনেই এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে- তেজগাঁও এফডিসির মসজিদ কমপ্লেক্স, গুলশান-১ এ অল কমিউনিটি ক্লাবের রুফটপ, কক্সবাজারে টেনসাইলে করা ফিলিং স্টেশন, টেনসাইলে করা বনানী ক্লাব, গ্রেগোরিয়ান ক্লাবের টেনসাইল স্ট্রাকচার, পান্থপথে কাউ কোম্পানির কাট আউট উইজ অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, মিরপুর ডিওএইচএস ও মহাখালীর ব্রেন স্টেশনের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, নিকেতনে ডেকোর গ্যালারী, শাহবাগে ভাসকুলার সার্জারী বিভাগের রেনোভেশনের কাজ, নরসিংদীতে বেলাবো মসজিদ, টেনসাইলে কাজ করা বোট ক্লাব, রংপুরে ডা: সাকলাইনের আরিজ স্কুল, গুলশান-১ এ হোটেল লেক উড ইন্টেরিয়র, ফেনীতে জামে মসজিদ, কাশিবাড়ি রিসোর্টে টেনসাইলের কাজ, কক্সবাজারে হোটেল নিসর্গ এর রোনোভেশন, মালিবাগে ক্যান্টেন রেস্টুরেন্টে রেনোভেশন, সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। এ ছাড়াও বর্তমানে তিনি বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন। ২০০৬ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্বামীর নাম মো: শাহজাহান মিয়া, পেশায় প্রকৌশলী। এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক-জননী। বড় মেয়ে ফাইমা ইজান হলিক্রস স্কুল এন্ড কলেজে এইচএসসির প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছোট মেয়ে রাকিনা ইজান ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী।
সম্পর্কিত

তরুণ স্থপতিদের উদ্দেশ্যে স্থপতি লতিফা সুলতানা বলেন, একজন স্থপতি হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার পথে সৃজনশীলতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। সৃজনশীল চিন্তাভাবনার মাধ্যমে নতুন ধারনা সৃষ্টি করে নকশায় নতুনত্ব আনা যায়, যা একজন স্থপতিকে আলাদা করে পরিচিতি এনে দেয়। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল টুলসের ব্যবহার এই প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করে তোলে। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার যেমন থ্রি ডি মডেলিং, সিমুলেশন এবং রেন্ডারিং- তাতে কাজের মানে বৃদ্ধি পায় এবং সময় বাঁচে।
পরিবেশবান্ধব নকশার প্রতি মনোযোগ দেওয়া বর্তমানে অত্যন্ত সময়োপযোগী। এই ধারা প্রাকৃতিক উপাদান এবং টেকসই উপকরণ ব্যবহার করে মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি স্থাপত্যের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। স্থপতি হওয়ার জন্য প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন স্থাপত্য শৈলী, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং আধুনিক প্রবণতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতেহবে। নকশায় নতুন ট্রেন্ড এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সময়ের চাহিদা পুরণে সহায়ক হতে পারে। স্থপতির কাজ শুধু বিল্ডিং ডিজাইন করা নয়, এটি মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। একটি জায়গার স্থাপনা শুধু তার নান্দনিকতা নয়, বরং তার সমাজ, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির প্রতিফলনও বহন করে। দুবাইয়ের আধুনিক স্থাপত্য বা রোমান সাম্রাজ্যের শৈলী এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এগুলোর মধ্যে শক্তি, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির অসাধারণ সংমিশ্রণ দেখা যায়। ইন্টারডিসিপ্লিনারি কাজ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের পেশাদারদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা এবং আইডিয়া অর্জন করা যায়। এর পাশাপাশি বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা একজন স্থপতিকে আরও দক্ষ করে তোলে।
স্থপতি লতিফা সুলতানা কাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, আমার পছন্দের জায়গা হলো ঞবহংরষব অৎপযরঃবপঃঁৎব নিয়ে কাজ করা। এই ক্ষেত্রে আমি এমন উপকরণ ব্যবহার করতে পছন্দ করি যা টান, বাঁধন বা বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয় কাঠামো, ইম্প্রেশন এবং স্থায়িত্বের জন্য। টেনসাইল স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ অংশ। এটি আর্চ, ডোম বা শেড তৈরির জন্য কাজে আসে, যা ফ্যাব্রিকের মাধ্যমে একটি স্থানকে সান, রেইন বা অন্যান্য আবহাওয়া পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। এই ধরনের ফোকাসড কাজ একটি স্থপতিকে নিজের বিশেষত্ব গড়তে সাহায্য করে। বিশেষ ভাবে আমি মসজিদ ডিজাইন করতে পছন্দ করি। কারণ এটি এমন একটি স্থাপত্য যা আমার সফট কর্নার হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও আমি ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়েও বেশ কিছু কাজ করেছি।
স্থাপত্য নিয়ে ভাবনা, চিন্তা বা দর্শন অনেক গভীর এবং বহুমুখী হতে পারে। স্থপতি বা আর্কিটেক্ট হওয়ার মানে শুধু একটি বিল্ডিং ডিজাইন করা নয়, বরং একটি স্থানের মানুষের এবং সময়ের সংযোগ ঘটানো। স্থাপত্য শুধুমাত্র রচনা শৈলী নয়, একটি মানুষের জীবন যাত্রা, আবেগ, সমাজ এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি জটিল শিল্প ও বিজ্ঞান। একটি জাতির জীবন যাত্রা এবং অগ্রগতি মূলত তার স্থাপনা, নির্মাণ শৈলী এবং শহরের অবকাঠামো দ্বারা প্রতিফলিত হয়। যখন আমরা একটি শহরের স্থাপনা দেখি সেটা শুধু তার নকশা বা নির্মাণের আধুনিকতা নয় বরং সেখানকার সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক কিছু বলেও যায়। বুর্জ খলিফা, পাম, জুমেইরা, দুবাই মলের মতো বিশাল শপিংমল এবং অবকাঠামো শুধু দুবাই নয়, বরং আরব বিশ্বের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনেরও একটি দৃশ্যমান চিহ্ন। রোমান সভ্যতা এবং রোমান স্থাপত্য একে অপরের পরিপূরক। রোমান স্থাপত্য শুধু তাদের ঐতিহাসিক শক্তি এবং সাম্রাজ্যিক ক্ষমতা নয়, বরং তাদের সংস্কৃতি, আইন এবং প্রযুক্তি এর প্রতীকও। রোমান সভ্যতা, তাদের স্থাপত্যের মাধ্যমে, এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল, যা আজও আধুনিক স্থাপত্যশাস্ত্রে অত্যন্ত প্রভাবিত।
স্থাপত্য কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি জীবনযাত্রার প্রকাশ। এর জন্য অধ্যবসায়, মনোযোগ এবং নতুন শেখার প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখা জরুরী। এই জার্নি কেবল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে না বরং মানুষের সঙ্গে স্থাপত্যের গভীর সম্পর্ককেও সমৃদ্ধ করে।