গাইবান্ধার এক সময়ের পরিত্যক্ত ঘাঘট লেক এখন দৃষ্টিনন্দন বিনোদন পার্ক। ছয় কিলোমিটার এ লেকের চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা, সিঁড়ি, অত্যাধুনিক দৃষ্টিনন্দন দুটি সেতু পার্কটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ডেভিট কোম্পানিপাড়া ও পূর্বাপাড়া সংলগ্ন নান্দনিক সেতু দুটি যেন হয়ে উঠেছে বিনোদন পিপাসুদের প্রমোদ ঠিকানা। প্রতিদিনই বিকেল হলেই এখানে বাড়তে থাকে শিশু-কিশোর-যুবকসহ সব বয়সী মানুষের ভিড়। দিনের আলোর থেকেও দৃষ্টিনন্দন এই সেতুর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় রাতের বেলা। তাই দিনের পাশাপাশি রাতেও বন্ধু-স্বজন, সহকর্মী ও পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। এই লেক কিছুটা ঢাকার হাতিরঝিলের আদলে তৈরি করায় স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছে ‘গরিবের হাতিরঝিল’।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধা শহরের ঘাঘট লেক শহরের ভেতর দিয়ে বয়েচলা এক সময়ের যৌবনা ঘাঘট নদী। ১৯৯০ সালের দিকে নদীটির গতিপথ পরিবর্তনে লুপ-কাটিং করে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরের দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরেই নামকরণ হয় ঘাঘট লেক। কিন্তু নাম করণের পরেও দীর্ঘদিন মূল ঘাঘটের প্রায় ছয় কিলোমিটার নদীর অংশ একবারেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ভরে যায় ময়লা-আবর্জনায়, হয়ে ওঠে পোকামাকড়ের অভয়ারণ্য।
গাইবান্ধাবাসীর এই ঘাঘট লেকটিকে বিনোদন কেন্দ্রে রূপ দেওয়ার প্রাণের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। ছোট্ট এই শহরে উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র বলতে শহরের ভিতরে ক্ষুদ্র একটি মাত্র পৌরপার্ক ছাড়া আর কিছুই না থাকায় সময়ের সাথে সাথে এ দাবি জোরালো হতে থাকে। পরে স্থানীয় লোকজন, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনের সাংসদ মাহাবুব আরা বেগম গিনির উদ্যোগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ‘ঘাঘট লেক উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ওই বছরই ছয় কিলোমিটার লেকের নির্মাণ কাজ শুরু হয় সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এক বছরের মাথায় অজ্ঞাত কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
২০২১ সালের ৩০ মে শহরের বিশিষ্টজন ও সচেতন নাগরিক সমাজের আয়োজনে ‘ঘাঘট লেক বাঁচাও, ঘাঘট বিনোদন কেন্দ্র বাঁচাও, পরিবেশ বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে মানববন্ধন করা হয়। এছাড়া বিভিন্নভাবে প্রকল্পের কাজ চালুর দাবি জানান গাইবান্ধাবাসী।
অবশেষে ২০২২ সালে ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই লেকের প্রায় দুই কিলোমিটার দখল-উচ্ছেদ না হওয়ায় বাকি চার কিলোমিটার অংশে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের দুই পাশে চার দশমিক চার কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ কাজ এক হাজার ১০৬ মিটার পাকা রাস্তা, চার দশমিক চার কিলোমিটার ফুটপাত, তিন ভেন্টের একটি ও এক ভেন্টের একটি স্লুইসগেট, ২০টি বসার বেঞ্চ, একটি ওয়াশ ব্লক, দুটি ডাম্পিং স্টেশন, চারটি সিঁড়ি ও দৃষ্টিনন্দন দুটি সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি। চলতি বছরের জুনে কাজ শেষ হলে নতুন রূপে সবার সামনে আসে ঘাঘট লেক।
রোববার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, শিশু-কিশোর-যুবকসহ সব বয়সী মানুষের ভিড়ে কোলাহলপূর্ণ লেকের নান্দনিক সেতু। সেতুর ছোট ছোট বেঞ্চে বসে গল্প করছেন কেউ কেউ। কেউ আবার ছবি তুলছেন, কেউবা তুলছেন সেলফি। হৈ চৈয়ে ব্যস্ত কেমলমতি শিশুরা। ঘাঘট লেকের এই দৃষ্টিনন্দন সেতুকে কেন্দ্র করে এখানে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক বেকার যুবকের। স্থায়ীভাবে গড়ে উঠেছে কনফেকশনারি, ফুসকা, চটপটি আর হালিমের দোকান। এছাড়া মৌসুমী ভাঁপাপিঠা ও ঝালমুড়ির ভাসমান দোকানও রয়েছে, যা বিনোদন প্রেমীদের বাড়তি আকর্ষণ।
অপেক্ষার সন্ধ্যা নামতেই সংক্রিয়ভাবে জ্বলে ওঠে সেতুর ল্যাম্পপোস্টের বাতি। দিনের আলোর থেকেও দৃষ্টিনন্দন এই ব্রিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় রাতের বেলা। সেতুতে স্থাপন করা হয়েছে সেন্সর পদ্ধতির আধুনিক লাইট। এসব লাইটের রঙিন আলোয় আলোকিত হয় রাতের ঘাঘট লেক। মুগ্ধ করে বিনোদন প্রেমীদের।
লেকপাড়ে ঘুরতে আসা কলেজ শিক্ষার্থী গ্রামের সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘মুক্ত বাতাসের ঠিকানা বলা যায় আমাদের এই ঘাঘট লেককে। যানজট ও কোলাহলমুক্ত ঘাঘট লেকের অন্যরকম একটা পরিবেশ, সেলফি তুলছি, ঝালমুড়ি খেয়েছি, ভালো লাগছে’।
পলাশবাড়ি থেকে আসা নূর আলম বলেন, ‘শহরে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম এখান থেকে একটু ঘুরে যাই। এসে ভালোই লাগছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘লেকটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে পর্যাপ্ত পানি, পানিতে নৌকা, ভাসমান খাবার হোটেল ও দখল হওয়া দুই কিলোমিটার বাঁধ দখলমুক্ত করে বৃক্ষরোপণ ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা গেলে এটি জেলার অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। একইসাথে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সিরাজউদ্দিন বলেন, ‘ব্যস্ততার এই সময়ে সন্ধ্যার পর স্ত্রী-কন্যাসহ পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছি। দিনের থেকেও রাতের এই লেক আমাদের বেশি আকর্ষণ করে। কেননা লেকের আধুনিক লাইটের আলোতে এটি দৃষ্টিনন্দন দেখায়।’
গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র মতলুবর রহমান বার্তা২৪.কম কে বলেন, ‘অল্পদিনের মধ্যেই লেকটির উন্নয়ন কাজ শুরু করা হবে। বারো মাসই কৃত্রিম পানি সরবরাহ করে স্বচ্ছ পানিতে পরিপূর্ণ থাকবে লেক। যেখানে নৌকা চলবে, দুই পাশের পুরো লেকে থাকবে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা। আর তখন ঘাঘট লেকটি একটি পরিপূর্ণ বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।’