এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
ডিপফেক প্রযুক্তি যেমন একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির চমৎকার উদাহরণ, অন্যদিকে এটি আজকের বিশ্বে এক নতুন আতঙ্কের নাম। সহজ কথায়, ডিপফেক হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং মেশিন লার্নিং-এর সাহায্যে তৈরি এমন ভিজ্যুয়াল বা অডিও কনটেন্ট, যা দেখে-শুনে বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু আদতে তা পুরোপুরি কৃত্রিম।
ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির ছবি, ভিডিও বা কণ্ঠস্বর এডিট করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে মনে হয়, তিনি সত্যিই ওই কাজটি করেছেন বা কথাগুলো বলেছেন। এটি একদিকে বিনোদনের জগতে যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, তেমনই ভুয়া খবর ছড়ানো, বিভ্রান্তি তৈরি, ব্ল্যাকমেলিং, এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
ডিপফেক প্রযুক্তির উত্থান
ডিপফেক শব্দটি এসেছে “ডিপ লার্নিং” এবং “ফেক” শব্দের মিশ্রণ থেকে। ২০১৭ সালে প্রথম এই প্রযুক্তি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। রেডিটে কিছু ব্যবহারকারী ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন সেলিব্রিটির মুখ একটি ভিন্ন ভিডিওর সাথে মিলিয়ে পোস্ট করেন। এর ফলে প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক সবার নজরে আসে।
এই প্রযুক্তি মূলত জেনারেটিভ অ্যাডভার্সারিয়াল নেটওয়ার্কস ব্যবহার করে কাজ করে। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন এক অ্যালগরিদম যা একটি বাস্তবসম্মত ভিডিও বা অডিও তৈরি করতে পারে। এটি দুটি অংশ নিয়ে কাজ করে: জেনারেটর এবং ডিসক্রিমিনেটর। প্রথমটি ভুয়া কনটেন্ট তৈরি করে, আর দ্বিতীয়টি সেই কনটেন্টকে বাস্তব থেকে আলাদা করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিপফেক দিন দিন আরও নিখুঁত এবং বাস্তবসম্মত হয়ে উঠছে।
বাস্তব জীবনে ডিপফেকের নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি উদ্বেগজনক। নির্বাচনের সময় ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করা তার একটি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে আমেরিকার নির্বাচনে ডিপফেক নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল। এছাড়া মানুষের ছবি বা কণ্ঠস্বর নকল করে ব্যাংক বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা প্রতারণার শিকার হচ্ছে।ব্যক্তিগত ভিডিও বা ছবি এডিট করে কাউকে ব্ল্যাকমেল করা ডিপফেকের একটি বড় সমস্যা। ভুয়া ভিডিও বা অডিও তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে এর মাধ্যমে।
ডিপফেক শনাক্ত করার প্রযুক্তি
ডিপফেক শনাক্ত করার জন্যও নানা প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে। বড় প্রযুক্তি সংস্থা যেমন মাইক্রোসফট, ডিপট্রেস, ফেসবুক ডিপফেক সনাক্তকরণে কাজ করছে। এআই এর মাধ্যমে ভিডিওর পিক্সেল অস্বাভাবিকতা, আলো ও ছায়ার ভুল এবং মুখের অভিব্যক্তির অস্বাভাবিকতা পরীক্ষা করে ডিপফেক চিহ্নিত করা যায়।
ডিপফেকের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে কড়া আইন প্রণয়ন এবং ডিপফেক কনটেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, যাতে ভুয়া ভিডিও দেখে বিভ্রান্ত না হয়।
প্রভাব
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ২০২০ সালে ডিপফেক নিয়ে বিশদ রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্ট বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মাতা ডিপট্রেস অনলাইনে ১৫ হাজার ডিপফেক ভিডিওচিত্র খুঁজে পেয়েছেন যার বেশির ভাগই ছিল পর্নোগ্রাফি ভিডিওচিত্র। তার মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ হলো নারী সেলিব্রিটিদের চেহারা পর্নো তারকাদের চেহারায় প্রতিস্থাপন করা।
বাজফিড ভিডিওর ইউটিউব চ্যানেল থেকে ২০১৮ সালে বারাক ওবামার ভিডিওচিত্র প্রকাশ করা হয়। যেখানে দেখা যায়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন পরিপূর্ণ বোকা বা অযোগ্য ব্যক্তি বলেন। ওটা মূলত ডিপফেক ভিডিও ছিল। ২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডিপফেক প্রকাশ পায়। ওই ভিডিওচিত্রে তাকে দেখা যায় সাক্ষাৎকারের সময় ঘুমিয়ে পড়ছেন, ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ডিপফেকের ব্যবহার মূলত রাজনীতি, সামাজিক অস্থিরতা এবং প্রতারণার জন্য লক্ষ্যণীয়। সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে প্রার্থীদের নামে ভুয়া ভিডিও তৈরি করে প্রচারণা চালানো হয়েছে। যেমন, ২০২৩ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় গাইবান্ধা-১ আসনের এক প্রার্থীর ছবি ব্যবহার করে তার নামে ভুয়া প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ভিডিও প্রচার করা হয়েছিল। এটি জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল।
এছাড়াও, ডিপফেক বাংলাদেশে সামাজিক মিডিয়ায় অপপ্রচার এবং ব্যক্তিগত ব্ল্যাকমেইলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীদের ছবি বা ভিডিও এডিট করে কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে, যা মানহানি এবং হুমকির কারণ হয়েছে।
ডিপফেক প্রযুক্তি আধুনিক প্রযুক্তির একটি চমকপ্রদ উদ্ভাবন হলেও এর অপব্যবহার মানব সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। এর ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগাতে এবং নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক।