প্যাসিভ আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করতে চান সাঈদা আক্তার – আনন্দ আলো

প্যাসিভ আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করতে চান সাঈদা আক্তার – আনন্দ আলো

পরিবেশ বান্ধব, মানব বান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যচর্চা করে যাচ্ছেন স্থপতি সাঈদা আক্তার মুমু। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর রয়েছে ‘মাত্রিক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এবং প্রধান স্থপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছে। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। ২০১৯ সালে ভারতের স্বনামধন্য ২৯ তম জে কে সিমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতায় ইয়ং আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক


সম্পর্কিত

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই ভবন ডিজাইন করতে চান স্থপতি সাঈদা আক্তার মুমু। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়। কিন্তু জন্ম চট্টগ্রামে। বেড়ে ওঠা খুলনা নিউজ প্রিন্ট মিলস লিমিটেড-এলাকায়। তিন ভাই বোনের মধ্যে মেঝ স্থপতি সাঈদা আক্তার। সাঈদার বাবার নাম মোহাম্মদ শাহ্ আলম খান। তিনি বাংলাদেশ ক্যামিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তা ছিলেন। মা শামসুন্নাহার আলম বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপিকা ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মুমু সংস্কৃতির বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকাআঁকি করতেন। গান ছিল তার পছন্দের বিষয়। লালন, লোক সঙ্গীত ভালো গাইতেন। সেই ছোটবেলা থেকেই গানের চর্চা করে যাচ্ছেন তিনি। কাজের ফাঁকে এখনো গেয়ে যাচ্ছেন গান। তিনি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভূক্ত লালন সঙ্গীত শিল্পী। গান আর সৃজনশীল কাজ দুটিই করে যাচ্ছেন সমানতালে। খুলনা নিউজ প্রিন্টস মিলস হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০০৮ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাশ করে বের হওয়ার পর পরই তিনি যোগ দেন সিস্টেম আর্কিটেক্টস-এ। সেখানে তিনি তিন বছর কাজ করেন। ২০১০ সালে স্থপতি সাঈদা আক্তার মুমু নিজেই গড়ে তোলেন ‘মাত্রিক’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে ইলশা রেস্টুরেন্ট, গাজীপুরে ডেকো গামেন্টর্স লিমিটেড ফ্যাক্টরি, গাজীপুরে ফ্যাশন এশিয়া লিমিটেড ফ্যাক্টরি, গাজীপুরে ভিয়্যালাটেক্স ইকো কোচার ফ্যাক্টরি বিল্ডিং, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রেসিডেন্স গ্যালাক্সি, মুসা স্পেশালাইজড হসপিটাল, গাজীপুরে সাব লাইন গ্রীনটেক্স লিমিটেড ফ্যাক্টরি, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলস লিমিটেড ফ্যাক্টরি, ইশো ফানিচার্স লিমিটেড ফ্যাক্টরি, টঙ্গীতে ইউনিয়ন স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড ফ্যাক্টরি, চট্টগ্রামের খুলশিতে বিএমডব্লিউ কমার্শিয়াল বিল্ডিং, মানিকগঞ্জে ডেরা রিসোর্ট, নারায়নগঞ্জে মাহিন অ্যাকসোসারিস লিমিটেড ফ্যাক্টরি, সিলেটের আল মদিনা মসজিদ, কানাডায় কানাডা ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ইন্টারন্যাশনাল হোটেল লা কুইম্ব সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন তিনি। এছাড়াও বর্তমানে বেশ কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন।

Deco garments Factory Gazipur

 

 

saida aktar mumu

স্থপতি সাঈদা আক্তার মুমুর নজর কাড়া নকশায় নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এক অনন্য স্থাপনা ইলশা রেস্টুরেন্ট। এ রেস্টুরেন্টটি বাংলাদেশে আধুনিক নির্মাণ শৈলীর অনন্য নজির। স্থাপনাটি সম্পর্কে স্থপতি সাঈদা বলেন, প্রজেক্ট ইলশা বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাবকে স্থাপত্যের মাধ্যমে উদযাপন ও তুলে ধরার এক চমৎকার উদাহরণ। ইলিশ মাছকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশিদের খাদ্য উৎসব এবং জীবন যাত্রার সঙ্গে এই প্রকল্পের গভীর সংযোগ রয়েছে। পদ্মা নদীর তীরবর্তী মাওয়া ঘাটের এই স্থানটি শুধু একটি দর্শনীয় স্থাপনাই নয়, এটি মানুষের ভালোবাসা এবং জাতিগত গৌরবেরও প্রতীক। ইলিশ মাছকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়েছে, তার প্রতিচ্ছবি এই নকশায় পরিলক্ষিত হয়। স্থাপত্যের বিমূর্ত ইলিশ প্রতিমা নদীর বুকে ভেসে ওঠার মতো নকশা জনসাধারনকে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে সংযুক্ত করে। বাংলাদেশের উৎসব গুলোর গুরুত্বপূর্ন অংশ যেমন পহেলা বৈশাখ, বিবাহের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান এবং হালখাতার সঙ্গে ইলিশের সংযোগকে এ স্থাপত্যে ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির নকশায় কেবল একটি খাবারের স্থান নয়, বরং একটি ভাস্কর্য স্থান হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

যেখানে লোকেরা বসে শুধু খাবার উপভোগ করে না, বরং দেশের মাটির সঙ্গে পানির সঙ্গে এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। স্থাপত্য জীবনকে উদযাপন করা উচিত এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে প্রকল্প ইলিশ বাংলাদেশের নদীমাতৃক জীবন ও উৎসমুখী সংস্কৃতিকে স্থায়ী ভাবে সম্মান জানায়। ২০১৪ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্বামীর নাম হোসেইন মোহাম্মদ নাহিয়ান। তিনিও একজন আর্কিটেক্ট। সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক-জননী। স্থপতি সাঈদা আক্তার বলেন, পরিবেশ বান্ধব ভবন বা গ্রীন বিল্ডিং বলতে এমন কাঠামো ও প্রক্রিয়া বোঝায় যা ভবনের পুরো জীবন চক্রে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল ও সম্পদ সাশ্রয়ী। এটি পরিকল্পনা, নকশা, নির্মাণ, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও ধ্বংস সহ প্রতিটি ধাপে কার্যকর হয়। সফল বাস্তবায়নের জন্য স্থপতি, প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও ক্লায়েন্টের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন। গ্রিন বিল্ডিং পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ কমানো এবং সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করে। এটি কম খরচে উচ্চ দক্ষতা ও পরিবেশ সুরক্ষার দিকে মনোযোগ দেয়। USGBC LEED একটি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সবুজ বিল্ডিং সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল (USGBC) দ্বারা পরিচালিত হয়। একটি পরিবেশ বান্ধব ভবন তৈরির জন্য নকশা, নির্মাণ, অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণের বিভিন্ন দিক মূল্যায়ন করে। লীড সার্টিফিকেশন অর্জন করলে সংশ্লিষ্ট ও ব্যবহারকারীরা আর্থিক সাশ্রয়, পরিবেশ রক্ষা এবং উচ্চতর জীবনমান উপভোগ করতে পারে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি সাঈদা আক্তার মুমু বলেন, একজন স্থপতি হিসেবে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, আমি প্যাসিভ আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করতে চাই, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই ভবন ডিজাইন করা যাবে। আমার লক্ষ্য হলো এমন ভবন তৈরি করা, যা স্বাভাবিক তাপমাত্রা, আলো এবং বাতাসের মাধ্যমে শক্তির ব্যবহার কমিয়ে দেয় এবং বাসিন্দাদের জন্য আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করে। যেমন সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তির ব্যবহার, প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের নকশা এবং টেকসই নির্মাণ উপকরণকে অন্তর্ভূক্ত করে এমন নকশার দিকে মনোনিবেশ করতে চাই। প্যাসিভ কুলিং ও হিটিং সিস্টেম, ছাদে সবুজায়ন এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে আমি এমন ভবন তৈরি করতে চাই যা পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব কমাবে। আমার বিশ্বাস প্যাসিভ আর্কিটেকচার হলো ভবিষ্যৎ নির্মাণের অন্যতম চাবিকাঠি, যা আমাদের ভবন গুলোকে আরো টেকসই এবং শক্তি সাশ্রয়ী করে তুলবে। এই পথে কাজ করতে আমি আমার স্থাপত্য দক্ষতা এবং সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে চাই, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ, টেকসই এবং আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।

viyaltext eco cochar factory gazipur

Scroll to Top