মামুনুর রহমান
হিমালয় কন্যা হিসেবে পরিচিত দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। শুধু ইতিহাস আর ঐতিহ্যেই নয় অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা পঞ্চগড়। শীত প্রবণ এই জেলার তেঁতুলিয়া থেকে দেখা যায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা তাও আবার খোলা চোখে! চোখের সামনে ভেসে থাকা হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী দৃশ্য যে করোরই মন কেড়ে নেয়। বাংলাদেশ-ভারতের বুক চিরে বয়ে যাওয়া সীমান্ত নদী মহানন্দায় সূর্যাস্ত দর্শন, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, সমতল ভূমিতে গড়ে ওঠা সবুজের নৈসর্গ চা বাগানসহ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর পঞ্চগড়। সব মিলিয়ে স্বর্গীয় অনুভূতি। মোগল আমলের স্থাপত্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বারো আউলিয়ার মাজার, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বদেশ্বরী মন্দির, রকস মিউজিয়াম, প্রাচীন ডাকবাংলো, পিকনিক কর্নার, কাজী অ্যান্ড কাজী এষ্টেটের আনন্দ ধারা, শিশুপার্ক, ভুগর্ভস্থ এ নদী থেকে পাথর উত্তোলন দেখলে পর্যটকদের চোখ জুড়িয়ে যাবে। প্রচুর টাকা খরচ করে চীনের তিব্বত, নেপাল বা ভারতে গিয়ে নয় ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো তে দাঁড়িয়েই খালি চোখে দেখতে পাবেন হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। তেঁতুলিয়া ভ্রমনের সময়টিকে বেছে নিতে হবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে। জুলাই আগস্টে দেখা মেলে কাঞ্চজঙ্ঘার। তবে এজন্য বৃষ্টির তপস্যা যেমন দরকার তার সাথে সাথে সূর্যের আলোর ঝলকানিও দরকার। তবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরে ঋতুবৈচিত্র্যের মাঝে শীতের শুরুর দিকে মেঘমুক্ত নীলকাশে ভেসে ওঠে তুষারশুভ্র হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা।
সম্পর্কিত
পাহাড়ের বরফ শুভ্র গায়ে সূর্যের আলো পড়লে চকচকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার একাধিক রুপ চোখে পড়ে। এ দৃশ্য দেখার জন্য দূরবিন বা বাইনোকুলারের দরকার নেই। মোহনীয় এ দৃশ্য দেখতে দেশি বিদেশী পর্যটকেরা তেঁতুলিয়া ভ্রমণ শুরু করেছেন। কেউ একাকি কেউ পরিবার নিয়ে প্রতিদিনই ভীড় করছেন তেঁতুলিয়ায়। তেঁতুলিয়ার পুরোনো ডাক বাংলোর পাশে প্রবাহিত মহানন্দার পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের বর্ণিল আলোয় উদ্ভাসিত অভূতপূর্ব দৃশ্যে অন্যরকম ভালোলাগার দ্যুতিতে মন ভরে যায়।দিনের আলো শেষে সীমান্তের কাঁটাতার ঘেঁষা ভারতের সার্চলাইটের আলো, শিলিগুড়ি শহরের নিয়নবাতি আর মহানন্দার বয়ে চলার শব্দ সময়টার আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়।
তেতুলিয়ায় থাকবেন কোথায়
আত্মীয় স্বজনের বাসা থাকলে ভিন্ন কথা। তবে যদি আত্মীয় স্বজন না থাকে তাহলে রাত্রী যাপনের জন্য তেতুলিয়ায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল। গুনে মানে নামে বিখ্যাত না হলেও রাত্রী যাপন করা যাবে এগুলোতে। তেতুলিয়া পিকনিক স্পষ্টটিতে রয়েছে জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের মোটামুটি মানের দুটি থাকার ভবন। রয়েছে সরকারি ডাক বাংলো। পাঁচশত টাকা থেকে আটশত টাকার মধ্যে রাত্রী যাপনের সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি ভাবে রয়েছে কাজী ব্রাদার্স আবাসিক হোটেল। ত্রিশ জনের আবাসিক সুবিধা সম্বলিত হোটেলেটিতে এসি/নন এসি রুযম গুলো ৩০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে রাত্রী যাপন করতে পারবেন। আরডিআরএস সংস্থার আবসিকে ২০০ টাকায় রাত্রী যাপনের সহজ সুবিধাও রয়েছে। এজন্য অবশ্য আরডিআরএসের পরিচিত কেউ থাকলে তার সহায়তায় রুম খালি থাকা সাপেক্ষে বরাদ্দ পাবেন আপনি। এছাড়াও রয়েছে হোটেল সীমান্ত। সিট সংখ্যা ১৪টি। রয়েছে নিরাপদ রেসিডেন্সিয়াল হোটেল। রুম ভাড়া ৩০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। সব গুলো হোটেলেই সিঙ্গেল ও ডাবল বেডের সুবিধা তো আছেই।
তেতুলিয়া আগামী দিনের বিজনেস হাব
সুন্দর তেতুলিয়া গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তেতুলিয়া শহরটিতে যে কজন মানুষ সামনের পথে হাঁটছেন। তাদের একজন মো: সাদেকুল ইসলাম। একজন নাট্যকমী। মঞ্চ অভিনেতা। তেতুলিয়া নাট্যগোষ্ঠী ও তেতুলিয়া সংগীত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। আর জীবিকার তাগিদে সরকারের রাজস্ব যোগাতে নিয়োজিত রয়েছেন একজন সিএন্ডএফ এজেন্ট হিসেবে। প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তেতুলিয়ায় মঞ্চ নাটক ও সংগীত নিয়ে কাজ করছেন। একজন সফল চা চাষী হিসেবেও নাম ডাক রয়েছে তার। তার চোখ দিয়ে আমরা দেখার চেষ্টা করেছিলাম তেতুলিয়ার পরিবর্তন গুলো। একসময় তেতুলিয়ায় মানুষ আসতে চাইতো না। ভাঙা রাস্তা ঘাট। দিনে কেউ আসলে পরদিন পৌছে তারপর দিন ফিরে যেতে হতো। আর আজ ইচ্ছে করলেই তেতুলিয়া থেকে ঢাকায় ফিরে কাজ শেষ করে রাতের মধ্যে তেতুলিয়ায় ফিরে আসা সম্ভব। এখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অসাধারন। সাদেকুল ইসলামের কথার ঝাঁপি যেন ক্রমেই খুলে যাচ্ছে। তেতুলিয়া থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে বাংলা বান্ধা স্থল বন্দর, এই বন্দরটিই বদলে দিয়েছে আমাদের আজকের জীবন। ভারত, নেপাল, ভূটান ও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সাথে এই স্থল বন্দর দিয়ে হাজার কোটি টাকার বানিজ্য হয় গড়ে প্রতি মাসে। অবহেলিত এই জনপদের মানুষ গুলো এক সময় কাজ খুঁজতে যেতো। আর এখন তারা অন্যদের কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিকে নিয়ে এসেছেন চা’এর মতো অর্থকরী রপ্তানী মুখী ফসল উৎপাদনে। এক একর চা’র বাগান থেকে বছরে খুব সহজেই সাত থেকে আট লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। তেতুলিয়ায় উৎপাদিত চা সেখানেই প্রক্রিয়াজাত হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়া সহ ইউরোপ, আমেরিকায়। আগামীর তেতুলিয়া আরও উন্নত হবে আরও আধুনিক হবে সে লক্ষ্যে মাঝবয়সী সাদেকুল শোনালেন আশার বানী। নিজের ব্যক্তিগত তিন একরের বেশি সম্পত্তির ওপর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন বিশ্ব মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বাংলাবান্ধা হাইওয়ের পাশে শুরু করেছেন তেতুঁলিয়া ইন্টান্যাশনাল সেন্টার। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ২০২২ সাল নাগাদ এই সেন্টার হবে ভ্রমণ পিপাসুদের প্রিয়স্থান। তিন তারকা সুবিধার এই হোটেলটিতে থাকবে রুফ টপ রেস্টুরেন্ট। আবাসিক সুবিধা। সুইমিংপুল। এশিয়ান, থাই, চাইনিজ ও বাংলাদেশি খাবার। সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এই প্রতিষ্ঠান থেকে শক্তি শালী বাইনোকুলার দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সুবিধা থাকবে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর, গাবতলি থেকে প্রতিনিই বাস যোগে এসি/ননএসি সুবিধার হানিফ পরিবহন ও নাবিল পরিবহনের মাধ্যমে সরাসরি তেতুলিয়া যেতে পারবেন। রেলপথে যেতে চাইলে কমলাপুর স্টেশন থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনে পঞ্চগড় পর্যন্ত গিয়ে পঞ্চগড় থেকে আবারও লোকাল বাস অথবা গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন তেতুলিয়ায়। আরও আরামে আকাশ পথে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর বিমান বন্দরে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে অথবা লোকাল বাসে যেতে পারেন সেখানে। বাসে নন এসি/এসি সুবিধায় তেতুলিয়া পর্যন্ত যেতে ৩০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা। ট্রেনে এসি/নন এসি সুবিধার ৬০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকা। আর আকাশপথে যে কোন এয়ারলাইন্সের ফ্লাট রেট গুলো অনলাইনে তো থাকছেই। তবে স্থানীয় রুটের গাড়ি ভাড়া গুলো আপনাকেই করে নিতে হবে।
যেসব সঙ্গে নেবেন
ব্যাগ গুছিয়ে নেবার সময় কাপড়ের পাশাপাশি খাতা বা ছোট্ট নোট বুক, কলম, ফোন চার্জার, নিতে পারেন একটা ডিএসএলআর, আর হ্যা রোদ চশমাটা নিতে ভুলবেন না কিন্তু। রাত্রী যাপনের জন্য যাত্রার পূর্বেই থাকার জায়গাটি কনফার্ম করে নেয়াটা হবে বুদ্ধিমানের। অন্তত পরিবার নিয়ে যাবার আগ অবশ্যই থাকার জায়গাটি আগেই ঠিক করুন।
কেন বেড়ানো দরকার
মানসিক চাপ আর উদ্বিগ্নতা ঝেড়ে ফেলতে চাইলে ঝটপট ব্যাগটা গুছিয়ে ফেলুন। মানিব্যাগটার স্বাস্থ্য যাচাই করে বেড়িয়ে পড়ুন বাড়ি থেকে। যতোটা পথ পাড়ি দেবেন মনে মধ্যে জমে থাকা চাপ, বিষন্নতা সব কিঝুই কমে যেতে থাকবে। নতুন নতুন স্থান দেখা আর নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে তৈরি হবে সম্পর্ক। এই অচেনা সঙ্গীর সাথে অল্প বিস্তর আলোচনায় বাড়তে পারে আপনার সামাজিক দক্ষতা। এক ঘেয়েমিতে হাঁপিয়ে ওঠা জীবনের জমে থাকা উদ্বিগ্নতা কমে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া উদ্যম ফিরে আসবে আবার। বেড়ানোর এই সময়টুকুতে আপনার মস্তিস্কটা চমৎকার বিশ্রাম নিয়ে নতুন কাজে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় আপনাকে সাহায্য করবে। অনেকের ধারনা বেড়ানো মানে জমানো অর্থের খোয়া যাওয়া। সময়ের অপচয়। এমনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। প্রাত্যহিক জীবনের গন্ডি মারিয়ে মুক্ত জীবনের স্বাদ নিতে বেড়ানো খুবই জরুরী। নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে নিজের চিন্তা গুলোকে গুছিয়ে নিতে ভ্রমণ বিস্তর উপকারি। যেদিন থেকে আপনার বেড়ানোর পরিকল্পনাটা মাথায় আসবে দেখবেন সেদিন থেকেই একটা চমৎকার উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। একটা অন্যরকম ভালো লাগার সৃষ্টি হয়েছে।
তৈরি হবে মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা
অনেক সময় দেখবেন আপনার পরিকল্পনা মাফিক কোন কাজ হচ্ছে না। গন্ডব্যের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছেন ঠিকই কিন্তু টিকিট করা হয়নি, কিংবা খারাপ আবহাওয়ার কারণে বের হতে পারছেন না। এমনও হতে পারে যাত্রাটাই বাতিল করতে হলো। এমন পরিস্থিতিতে মোটেও হতাশ হবেন না। চেষ্টা করলে নিজেই বিকল্প পেয়ে যাবেন। আর এতো সব অসঙ্গতিকে যখন নিজের সাথে মানিয়ে নিতে শিখবেন আপনার মনটাও তখন নমনীয় হয়ে উঠবে। আর বেড়ানো শেষে দেখবেন সব বিষয়ে মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে আপনার মাঝে।
হবেন ধের্যশীল
যে কোন ভ্রমণ আপনাকে ধের্যশীল হতে শেখাবে। ভ্রমণে বেড়িয়ে দেখবেন বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কখনও লাইনে দাঁড়িয়ে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে বা প্লেনে ওঠার জন্য। আবার কখনো খাবারের জন্য রেস্তোরাতে। এই অপেক্ষায় থাকার বিষয়টি উপভোগ করুন। কারণ এখানেই আপনার বেড়ানোর আসল মজাটা রয়েছে। এ সময়টি শেষ হলেই ফেরার পালা শুরু হবে। কথা বলুন এ সময়ে নতুন মানুষের সাথে। গড়ে তুলুন পরিচিতি। মাথা ঠান্ডা রেখে সময়টিকে উপভোগ করুন। দেখবেন ধৈর্যশীল হবার গুণাবলীটি তৈরি হয়েছে আপনার মাঝে।