বর্ষায়-বন্যায় সতর্ক ও নিরাপদ থাকুন

বর্ষায়-বন্যায় সতর্ক ও নিরাপদ থাকুন

অংকিতা চৌধুরী

এসেছে বর্ষাকাল। আর এই বছর বর্ষার শুরুতেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোসহ দেশের বেশ কিছু জেলায় দেখা দিয়েছে বন্যা। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের অবস্থা বেশ খারাপ। পানিবন্দি মানুষগুলো আতঙ্কে-শংকায় দিন কাটাচ্ছেন। এছাড়া বন্যা চোখ রাঙাচ্ছে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতেও। এতে জনজীবন পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে।

বন্যার ফলে প্লাবিতে এলাকার মানুষ ও পশুপাখি অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়। ব্যাধির বিস্তার বাড়ে। কারণ বন্যার সময় সাজানো-গুছানো জীবন ব্যাবস্থাগুলো ভেঙ্গে পড়ে। ময়লা-আবর্জনা, মলমূত্র সব গিয়ে মেশে ওই বন্যার পানিতেই। ফলে নানা ধরনের রোগবালাই বিশেষ করে সংক্রামক রোগের বিস্তার বেড়ে যায় বহুগুনে। এই সময়ে জীবনযাপনে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত সতর্কতার। সেই সতর্কতাগুলো নিয়েই সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বিআরবি হাসপাতালের চিকিৎসক শাহনাজ পারভীন।

সবার আগে বিশুদ্ধ পানি

স্বাভাবিক সময়ে তো বটেই বন্যার সময়েও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে সবার আগে। বন্যায় পানির উৎস দূষিত হয়ে যায়। তাই পানি ভালভাবে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করাসহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে হবে। বন্যার পানিতে টিউবওয়েল তলিয়ে গেলে এক কলস পানিতে তিন-চার চা চামচ ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে টিউবওয়েলের ভেতর এই পানি ঢেলে আধা ঘণ্টা রেখে এরপর একটানা আধা ঘণ্টা চেপে পানি বের করে ফেলে দিলে সেই পানি খাওয়ার উপযোগী হতে পারে। ব্লিচিং পাউডার না থাকলে এক ঘণ্টা টিউবওয়েলের পানি চেপে বের করে ফেলতে হবে। তবে নিরাপত্তার জন্য টিউবওয়েলের পানিও ভালমতো ফুটিয়ে নেয়া উচিত। পানি ছেঁকে জ্বলন্ত চুলায় একটানা ৩০ মিনিট টগবগিয়ে ফুটিয়ে তারপর ঠাণ্ডা করতে হবে।

পানি ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে প্রতি দেড় লিটার খাওয়ার পানিতে ৭.৫ মিলিগ্রাম হ্যালোজেন ট্যাবলেট, তিন লিটার পানিতে ১৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রেখে দিলে পানি বিশুদ্ধ হয়। বাসার পানির ট্যাংকের প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে ২৫০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার এক ঘণ্টা রাখলে পানি বিশুদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হয় না।

খাবার ও মলত্যাগে বিশেষ সতর্কতা

বন্যায় খাবারের নিয়মিত চক্র ভেঙে পড়ায় ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এ সমস্যার প্রতিকার নিজেকে জীবানুমুক্ত ও নিরাপদ রাখা। এ সময়ে খাবার গ্রহণের আগে থালাবাসন সাবান ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুতে হবে। বেশি রান্না না করে খিচুড়ি খাওয়ার কথা বলেন অনেকেই। আর বন্যার সময়ে যেখানে সেখানে মলত্যাগ একদম নয়। এতে পেটের পীড়া ও কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে হবে এবং মলত্যাগের পরে সাবান বা ছাই দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মলত্যাগের সময় কখনো খালি পায়ে থাকা চলবে না। কেননা বক্রকৃমির জীবাণু খালি পায়ের পাতার ভেতর দিয়ে শরীরে সংক্রমিত হয়। এ সময় দুই বছর বয়সের নিচের শিশু ছাড়া বাড়ির সবাইকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত।

রোগব্যাধি দূরে রাখার চেষ্টা

বন্যা সঙ্গে করে নিয়ে আসে নানা রোগব্যাধি। বিশেষ করে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ। এ সময় পানির উৎসগুলো সংক্রমিত হওয়ার কারণে পানিবাহিত রোগ বেশি হয়। ডায়রিয়া তো বটেই এছাড়া আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসও দেখা দেয় এ সময়ে। রোগগুলো থেকে সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া কিছু মশাবাহিত রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আটকে থাকা পানিতে এই রোগের জীবাণুগুলো সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে।

বন্যা পরবর্তী সময়ে মানুষের ত্বকে ফাঙ্গাসজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই বন্যার পানি গোসল বা গায়ে লাগানো যাবে না। এ সময়ে বিভিন্ন জীবাণুর ধারক ও বাহক পানির ফলে এ সময়ে নানা চর্মরোগ ও চোখের অসুখ দেখা দেয়। সবসময় পানির সংস্পর্শে থাকা এবং স্যাঁতসেঁতে ও ভেজা আবহাওয়ার জন্য হাতে ও পায়ের ত্বকে খোসপাঁচড়া, স্ক্যাবিস, আঙুলের মাঝখানে ঘা, টিনিয়া ইনফেকশন এ সময়ে স্বাভাবিকের চাইতে বেশি দেখা যায়। কৃমির প্রকোপ বাড়ে এ সময়ে। আবহাওয়া ও তাপমাত্রার তারতম্যজনিত কারণে নানা রকম ভাইরাসজনিত অসুখ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, সাইনোসাইটিস ইত্যাদি দেখা দেয়। সাবধানতা অবলম্বন করে এ রোগগুলোকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

ডায়রিয়া বিষয়ে খুব সাবধান

বন্যা ও বন্যাপরবর্তী সময়ে যেসব রোগ হয় তার মধ্যে অন্যতম ডায়রিয়া। এই রোগ প্রতিরোধে খাওয়ার আগে ও মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধুতে হবে। তবুও ডায়রিয়া যদি হয়েই যায় তাহলে পাতলা পায়খানা শুরুর পর নিয়মিত পরিমাণমতো খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে। দুই বছরের কম বয়েসী শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০-১২ চা চামচ এবং ২ থেকে ১০ বছরের শিশুকে ২০ থেকে ৪০ চা চামচ খাওয়ার স্যালাইন দিতে হবে। খাওয়ার স্যালাইন না থাকলে বিকল্প হিসেবে লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি ভাতের মাড়, চিঁড়ার পানি, ডাবের পানি, কিছু পাওয়া না গেলে শুধু নিরাপদ পানি খাওয়ানো যেতে পারে। এ সময় শিশুর পুষ্টিহীনতা রোধে খিচুড়ি খাওয়ানো যেতে পারে। রোগের সংক্রমণের হার কমাতে শিশুদের ভিটামিন-এ ক্যাপসুলও খাওয়ানো যেতে পারে। যদি পাতলা পায়খানা ও বমির মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

দুর্ঘটনা থেকে সতর্ক থাকুন

বন্যার সময় আকস্মিক নানা দুর্ঘটনা ঘটে। এর প্রধান কারণ অনভ্যস্ততা। কারণ এই বন্যার পানিতে বসবাসে অভ্যস্ত নই আমরা। এ সময়ে সাধারণত বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপ ও পোকামাকড়ের কামড়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। বন্যায় সাপের কামড়ে মারা যায় অনেক মানুষ। চারিদিকে পানি থাকায় বিষধর সাপও উঁচু স্থানে থাকা মানুষের ঘরে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়া পানির নিচে বহু বৈদ্যুতিক টাওয়ার, খুঁটি, ট্রান্সফরমার লাইনের তার ডুবে থাকে। এসব বৈদ্যুতিক লাইনের নিচ দিয়ে নৌকা বা ভেলা চালানোর ক্ষেত্রে বা চলাচলের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক হতে হবে। বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে বা পানিতে পড়ে থাকতে দেখলে তা স্পর্শ না করে বিদ্যুৎকর্মীদের জরুরিভাবে খবর দিতে হবে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Scroll to Top