বিদায়ী অর্থবছরে ১৩ বছরের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

বিদায়ী অর্থবছরে ১৩ বছরের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে কলে জানিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), যা এর আগের ১৩ অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড়ে ৯.০২% মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ০.৭১ শতাংশীয় পয়েন্ট।

এ সময়ে খাদ্য পণ্যে আগের অর্থবছরের ৮.৭১ শতাংশ থেকে ১.৯৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে দাড়িয়ে ১০.৬৫ শতাংশে। আর খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে ৯.৩৯ শতাংশ থেকে ০.৫৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৮৬ শতাংশে।

রোববার পরিসংখ্যান ব্যুরোর নিয়মিত প্রকাশনা ‘ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই), মূল্যস্ফীতি এবং মজুরি হার সূচক (ডব্লিউআরআই) বাংলাদেশ’-এর জুন জুন সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে। বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য দেওয়া সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য নামিয়ে আনা হয় আট শতাংশে।

বাজেটে বেধে দেওয়া মূল লক্ষ্যের চেয়ে ৩.৭৩ শতাংশীয় পয়েন্ট ও সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ১.৭৩ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে অর্থবছর শেষে।

বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, লক্ষ্যের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেধে রাখতে যেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, দরিদ্র মানুষদের মূল্যস্ফীতির প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতা ও ব্যর্থতার কারণে গত এক বছর ধরে নিম্ন আয়ের লোকজন বিশেষ করে স্থির আয়ের লোকজন বড় ধরনের চাপে ছিলেন বলেও তারা মনে করেন।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৬.৮২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থেকে পরের অর্থবছরে বেড়ে দাড়ায় ১০.৯২ শতাংশে। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১৭ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ঠেকে ৫.৪৪ শতাংশে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের ঘর ছাড়ায় এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি উঠে ৯.০২ শতাংশে। বিদায়ী অর্থবছরে আরেক দফায় বেড়ে মূল্যস্ফীতি উঠেছে ৯.৭৩ শতাংশে।

জুন মাসে কমেছে মূল্যস্ফীতি:
একক মাস হিসেবে জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৭২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। মে মাসে ৯.৮৯ শতাংশের চেয়ে এ সময়ে মূল্যস্ফীতি কমেছে ০.১৭ শতাংশীয় পয়েন্ট।

জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি শহর ও পল্লী অঞ্চলে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত এক কথায় সব সূচকেই জুন মাসে আগের মাসের তুলনায় কমেছে মূল্যস্ফীতি।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জুন মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০.৪২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা মে মাসে ছিল ১০.৭৬ শতাংশ। এ হিসাবে মাসের ব্যবধানে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে ০.৩৪ শতাংশীয় পয়েন্ট। একইভাবে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে মে মাসের ৯.১৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থেকে ০.০৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে জুন মাসে দাঁড়িয়েছে ৯.১৫ শতাংশে।

পল্লী অঞ্চলে জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৯.৮১ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। আগের মাসের ৯.৯৯ শতাংশ থেকে পল্লী অঞ্চলে জুনে মূল্যস্ফীতি কমেছে ০.১৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। এ সময়ে পল্লী এলাকায় খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০.৭৩ শতাংশ থেকে বেশ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ১০.৩৯ শতাংশে। আর পল্লী এলাকায় খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে ৯.৩১ শতাংশ থেকে সামান্য কমে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.২৬ শতাংশে।

শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি জুন মাসে ৯.৫৮ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে বিবিএস, যা মে মাসের ৯.৭২ শতাংশ থেকে ১৪ বেসিস পয়েন্ট কম। এ সময়ে শহর এলাকায় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০.৮৬ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১০.৫৪1 শতাংশে। আর খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে মে মাসের ৯.০৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি জুনে নেমেছে ৮.৯৮ শতাংশে।

যেভাবে মূল্যস্ফীতি হিসাব করে বিবিএস:
পল্লী ও শহর অঞ্চলে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত খাদের ৩৮৩টি পণ্য ও সেবার ৭৪৯টি ভ্যারাইটির দাম পর্যালোচনা করে প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন তৈরি করে বিবিএস। সারা দেশের ৬৪টি জেলার ১৫৪টি হাট-বাজার হতে নির্ধারিত সময়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অনলাইনে ও জরুরি ডাকের মাধ্যমে মূল্য ও মজুরি শাখায় প্রেরণ করেন সংস্থার মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা।

পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে জীবনযাত্রার ব্যয়ে এক বছরের পরিবর্তনের তথ্য তুলে আনে বিবিএস।

জুন মাসে ৯.৭২ শতাংশ পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির অর্থ দাড়ায় গত এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় ৯.৭২ শতাংশ হারে বেড়েছে। এক বছর আগে ১০০ টাকায় পাওয়া যেত এমন পণ্যের দাম এখন দাঁড়িয়েছে ১০৯.৭২ টাকায়। আয় একই হারে না বাড়লে ভোক্তাকে আগের চেয়ে কম পণ্য ও সেবা কিনতে হবে।

মজুরি হার মূল্যস্ফীতির নিচে:
বিদায়ী জুন মাসে ৯.৭৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির বিপরীতে শ্রমজীবী মানুষের মজুরি মাত্র ৭.৯৫ শতাংশ হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। এ হিসাবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির গতির চাইতে মজুরি আয় ১.৭৭ শতাংশীয় পয়েন্ট কম হারে বেড়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাইতে মজুরি হার এক থেকে দেড় শতাংশ বেশি হারে বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে মজুরি হার খুবই ধীরে বাড়ছে। টানা ২৯ মাস ধরে মজুরি হার মূল্যস্ফীতির নিচে অবস্থান করছে বলেও পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১২ মাসে গড়ে ৯.৭৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি হার বেড়েছে গড়ে ৭.৭৪ শতাংশ। এ হিসাবে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বেড়েছে ১.৯৯ শতাংশীয় পয়েন্ট কম হারে।

যা বলছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা:
গত অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ছয় শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারে অস্বাভাবিক চাপ, বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে ঘোষণা করা বাজেটে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আবার মূল্যস্ফীতির চাপ সামালে উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।

তিনি আরও বলেন, সুদের হারের ক্যাপ অনেক বিলম্বে উঠানোর কারণে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে পূরণ হয়নি।

সুদের হার এককভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না দাবি করে তিনি বলেন, দেশে বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো খাতের বিভিন্ন সঙ্কটে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলেও তিনি মনে করেন।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও উদ্যোগের ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, অনেক বিলম্বে সুদের হার বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তেমন কোন কাজে লাগেনি। বাজেট বাস্তবায়নে ব্যক্তি খাত বিশেষ করে দরিদ্র মানুষদের জন্যে বরাদ্দ বাড়াতে সরকার কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন করলেও সরকারি খাতে দেদার অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। লম্বা সময় ধরে বিনিময় হার স্থির রেখে কম সময়ের মধ্যে টাকার মানে বড় ধরনের অবনমনের কারণেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

চাঁদাবাজি, মজুদদারি, কার্টেলসহ বিভিন্ন কারণে পণ্যের দাম বাড়লেও এ সব অপকর্ম কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন।

মূল্যস্ফীতির কারণে স্থির আয়ের লোকজন বিশেষ করে দরিদ্র লোকজন সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি হার কমে আসলে মানুষের প্রকৃত আয় তথা ক্রয়ক্ষমতা কমে আসে। এই অবস্থা চলতে থাকলে মানুষের ভোগের পরিমাণ কমে আসে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ব্যয় কমাতে দরিদ্র লোকজন খাবার, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়ে লাগাম টানতে বাধ্য হয়। এ সব খাতে ব্যয় কমালে মানব সম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর প্রভাবে ভবিষ্যতে দরিদ্র মানুষের উৎপাদনশীলতা ও আয় কমে আসতে পারে।

Scroll to Top