যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অ্যাসাঞ্জের ১৪ বছর লড়াইয়ের আদ্যোপান্ত | চ্যানেল আই অনলাইন

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অ্যাসাঞ্জের ১৪ বছর লড়াইয়ের আদ্যোপান্ত | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

নিজের ওয়েবসাইট ‘উইকিলিকসে’ যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস করে ২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। এরপর দীর্ঘ ১৪ বছরের আইনি নাটকের অবসান ঘটিয়ে ২৫ জুন যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

এর জন্য যদিও শেষ পর্যন্ত নিজের দোষ স্বীকার করতে হয়েছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কারামুক্তি পান জুলিয়ান আসাঞ্জ। এবার তিনি ফিরে যেতে পারবেন নিজের জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়াতে।

উইকিলিকস এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অ্যাসাঞ্জ জেল থেকে বেরিয়েছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের বাইরে চলে গেছেন। সামাজিক মাধ্যমে উইকিলিকস জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলো, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য যারা লড়ছেন, আইনসভার সদস্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অ্যাসাঞ্জের মুক্তির জন্য যে প্রচার করেছিলেন সেটা জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
৫২ বছর বয়সী জুলিয়ান ১৯৭১ সালে উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার টাউনসভিলে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে তিনি উইকিলিকস নামের একটি হুইসেল-ব্লোয়িং ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়েবসাইটটিতে যে কেউ চাইলে গোপন নথি প্রকাশ করতে পারত।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার, হ্যাকার এবং ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট ছিলেন। তিনি সাইবার সুরক্ষা, গোপনীয়তা এবং সাইবার হামলার জন্য বিশ্বে বেশ পরিচিত।

মূল ঘটনা
২০১০ সালে উইকিলিকসে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রায় পাঁচ লাখ নথি ফাঁস করে দেন আসাঞ্জ। এসব নথিতে আফগানিস্তান ও ইরাকে মিলিটারির নানা কার্যক্রমের তথ্য রয়েছে।

প্রকাশিত ওই গোপন নথিতে থাকা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ২০০৭ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে। এতে বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ নিহত হন যার মধ্যে ছিলেন সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিকও। এছাড়াও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন থেকে শুরু করে সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের বিষয়ে নানান সমালোচনামূলক বার্তার তথ্যও প্রকাশিত হয়েছিল।

বার্তা ফাঁস করে দেয়ায় পর পরই আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রোষানলে পড়েন অ্যাসাঞ্জ। তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ১৮টি অভিযোগ আনা হয়, যার একটি গুপ্তচরবৃত্তি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে ১৭৫ বছর জেল খাটতে হতো।

২০১০ সালে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তিনি সেই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মার্কিন সরকারের একাধিক গোপন বার্তা ফাঁস করে দেয়ার জন্যই তিনি চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। পরে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাজ্যে গ্রেপ্তার করা হয়, তবে তিনি জামিন পান।

২০১২ সাল থেকে তিনি প্রায় ৭ বছর লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে কাটান। ধর্ষণের অভিযোগে তাকে যাতে গ্রেপ্তার না করা যায়, তার জন্য এই কাজ করেছিলেন তিনি। অ্যাসাঞ্জের আশঙ্কা ছিল, তাকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ছিল। পরে অবশ্য সুইডেনে তার বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়।

২০১৯ সালে তাকে ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে বহিস্কার করা হয়। তারপর থেকেই তিনি যুক্তরাজ্যের জেলে বন্দী ছিলেন। এরপর শুরু হয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেতার প্রক্রিয়া। কিন্তু লন্ডনের কারাগার থেকেই আদালতে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেন তিনি। অবশেষে দুইপক্ষের সমঝোতায় মুক্তি পেলেন অ্যাসেঞ্জ।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অ্যাসাঞ্জের চুক্তি
গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে মার্কিন আইন ভঙ্গ করার জন্য ক্ষমা চাইবেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। উইকিলিকস জানিয়েছে, মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অ্যাসাঞ্জ একটি সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছেছেন। ফৌজদারি অপরাধের দোষ স্বীকার করার বিনিময়ে অ্যাসাঞ্জকে কারামুক্ত করা হয়েছে।

উইকিলিকস বলছে, যুক্তরাজ্যের বেলমার্শ কারাগার থেকে বের হন অ্যাসাঞ্জ। কারাগারের একটি ছোট্ট কক্ষে ১ হাজার ৯০১ দিন বন্দী ছিলেন তিনি। কারাগার থেকে বেরিয়ে অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের স্ট্যানস্টেড বিমানবন্দরে যান। এক্স অ্যাকাউন্টে অ্যাসাঞ্জের একটি ভিডিও পোস্ট করেছে উইকিলিকস। সেই ভিডিওতে জিনস ও নীল রঙের শার্ট পরা অ্যাসাঞ্জকে স্ট্যানস্টেড বিমানবন্দরে দেখা গেছে।

সেখানে থেকে  অ্যাসাঞ্জের যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকা নর্দান মারিয়ানা আইল্যান্ডসে পৌঁছানোর কথা। সেখানে আগামী ২৬ জুন তার ৬২ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। তবে তিনি ইতিমধ্যেই এই সময়টা যুক্তরাজ্যের জেলে কাটিয়েছেন। ফলে সেখান থেকে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবেন।

তবে অ্যাসাঞ্জের মুক্তি এবং মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে তার আইনজীবী রিচার্ড মিলার কোনও মন্তব্য করেননি। এর আগে দীর্ঘদিন ধরে তার পক্ষের আইনজীবীরা দাবি করে আসছিলেন, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে করা মামলা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগ জানিয়েছে, নিজের অপরাধ স্বীকার করার বিষয়ে অ্যাসাঞ্জ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি করেছেন, সেটির ধারাবাহিকতাতেই তাকে ছেড়ে দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। অ্যাসাঞ্জ এখন নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবেন।

Scroll to Top