দর্শককে হলে আনার জন্য শিল্পীদের ব্যক্তিত্বও জরুরি

দর্শককে হলে আনার জন্য শিল্পীদের ব্যক্তিত্বও জরুরি

আহমেদ জামান শিমুল

সামিনা ইসলাম নিলা—দেশের অন্যতম মিনি সিনেপ্লেক্স ‘রুটস সিনে ক্লাব’-এর চেয়ারম্যান। ‘বুক বিডি শো’ নামক একটি বক্স অফিস অ্যাপ নিয়ে কাজ করছেন। এছাড়া দেশের সিনেমা হলগুলোর জন্য ই-টিকেটিং ও সেন্ট্রাল সার্ভার সিস্টেম নিয়েও কাজ করছেন। একই সঙ্গে সারাদেশে মিনি সিনেপ্লেক্স ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও উদ্যোগ নিয়েছেন। তাদের এসকল উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন সারাবাংলার সিনিয়র নিউজরুম এডিটর আহমেদ জামান শিমুল।

  • ‘বুক বিডি শো’ প্রজেক্ট কতদূর এগোলো?

কাজ মোটামুটি শেষের পথে। এখন ট্রায়াল চলছে। আশা করছি যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে আগস্টে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করতে পারবো।

  • কেনো, কী উদ্দেশ্যে এটা করছেন?

সহজ ভাষায় বললে চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওনার মুখে শুনেছি মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও নিয়ে ঘুমাতেন। যুদ্ধের গান ওনাদের অনেক উজ্জীবিত করতো। সে জায়গা থেকে চলচ্চিত্রের প্রতি আলাদা একটা দায়বদ্ধতা আছে। আবার আমার যিনি পার্টনার উনি কলকাতা মেডিকেলে পড়াশোনার সময় দেখেছেন, চলচ্চিত্র তাদের কাছে উৎসবের মতো। দৈনন্দিন জীবনের একটা অংশ। ওই জায়গা থেকে ওনারও চলচ্চিত্রের প্রতি একটা ভালোবাসা আছে। উনি প্রচুর চলচ্চিত্র দেখেন, এ নিয়ে পড়াশোনা করেন। সে জায়গা থেকে আমরা রুটস সিনেক্লাবের যাত্রা শুরু করেছিলাম। তবে তা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়।

দেখুন আমাদের চলচ্চিত্রের ৬৯ বছরের ইতিহাসে কোনো বক্স অফিস হয়নি। এটা তো সরকার অথবা বিএফডিসির করার কথা ছিল। ফলে আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়—সিনেমা নিয়ে হল মালিক, প্রযোজক-পরিচালক সবার মধ্যেই একধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। রুটস নিয়ে যখন কাজ শুরু করলাম, তখন আমরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হলাম। তখনই ভাবলাম, না আমাদের কিছু একটা করতে হবে।

  • আপনাদের অ্যাপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী?

‘বুক মাই শো’ নামে ভারতে একটা সাইট আছে। ওটা থেকে কিছুটা ধারণা নিয়েছি। তার চেয়ে ভালো কিছু অপশন নিয়ে আমরা ‘বুক বিডি শো’ নামক অ্যাপ নিয়ে কাজ করছি। আমরা সেন্ট্রাল সার্ভার নিয়ে কাজ করছি—যেটা আগামী বছর চালু করবো।

এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সিনেমা অন অফ করার জন্য কোনো সার্ভারের প্রয়োজন হবে না। প্রযোজক যদি জানতে চান তার ছবি কোন হলে কতজন দর্শক এবং উনি বুঝবেন প্রতিদিন কোন হলে কোন শোতে কতটা টিকেট বিক্রি হচ্ছে। হলে আলাদা কোনো প্রতিনিধি লাগবে না। দর্শকদের জন্য আমরা একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছি, যেটা অনেকটা ফেসবুকের মতো। সেখানে তো অনেক কিছু থাকে। তবে আমাদের এখানে শুধু চলচ্চিত্রবিষয়ক জিনিস থাকবে। আপনি চাইলে আপনাকে আমরা একটা একাউন্ট করে দিবো। যেখানে আপনারা শিল্পী, কলা-কুশলীদের ফলো করতে পারবেন। ছবির রিভিউ দিতে পারবেন। আমাদের অ্যাপসের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বসে সিনেমার টিকেট কাটতে পারবেন। যে কাউকে টিকেটটা উপহার দিতে পারবেন। শুধু সিনেমার টিকেট নয়, নাটক, প্রদর্শনী, খেলার টিকেটও কাটা যাবে। আবার সিনেমা নিয়ে নানাধরনের পুশ নোটিফিকেশনও পাবে তারা।

  • এ ধরনের অ্যাপস করার জন্য কোনো ধরনের সার্ভে করেছেন যারা আপনার সম্ভাব্য গ্রাহক হবে তাদের উপর? নাকি কয়েক বছরের হল চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে সাহস করে নেমে গেছেন?

আমরা ভেতরে ভেতরে ভেতরে যে সার্ভে করার চেষ্টা করি নাই, তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো এগুলো পেয়ে অভ্যস্থ নয়। যার কারণে এটাও অনেক হল মালিকের কাছে নতুন। অনেকে মনে করছে এটা করলে না জানি আবার কোন বিপদে পড়বো! কারণ তারা রেন্টাল, টেবিল মানিতে অভ্যস্থ। এটা ভাংগতেও তো একটু সময় লাগবে। এটা সাহসিকতা বলতে পারেন। আমরা একটু সাহস করেই এখানে হাত দিয়েছি। আমরা সিনেমা হল মালিকদের যদি বুঝাতে পারিন এটা টেবিল মানির চেয়ে ভালো—দুপক্ষেরই (প্রযোজক-হল মালিক) লাভ। এটা শুদ্ধ এবং স্বচ্ছ। এটা কিন্তু হল মালিকরা ফ্রি পাচ্ছেন।

  • শুধু কি ইন্সটলেশন পর্যন্ত ফ্রি থাকবে, নাকি এরপর চার্জ ধরবেন?

না, আমৃত্যু ফ্রি।

  • কিন্তু আমাকে প্রজেক্টের যে ব্রুশিয়ার পাঠিয়েছেন, সেখানে তো সার্ভারের জন্য ফি ধরেছেন—দেখলাম।

হ্যাঁ, সার্ভারের জন্য ৫০০ ও ১০০০ টাকা ভাড়া নিবো মাসিক ভিত্তিতে। এটার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ থাকে, সে জন্য এটা নেওয়া। অন্যান্য জায়গায় কিন্তু সাপ্তাহিক খরচ থাকে, আমরা তা ধরছি না।

  • আপনাদের অ্যাপসটি কি দেশীয় ডেভেলপাররা তৈরি করছেন, নাকি বিদেশিরাও আছেন?

দেশি-বিদেশি ডেভেলপাররা মিলে তৈরি করছেন।

  • ভারতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান কি আপনাদের সঙ্গে আছে?

আমরা একটা টিম মিলে কাজ করছি। যারা কাজ করছি তাদের নামও জানাবো, একটু গুছিয়ে নিই।

  • আপনারা যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন তাতে হল মালিক, প্রযোজক ও সরকারি সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি পক্ষ রয়েছে। তাদেরকে সম্মত করা কিংবা অনুমতির ব্যাপার রয়েছে। এদের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করছেন?

আমরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি। অনেক কিছুই সমাধান করতে পেরেছি। হল মালিক বা অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়েছে। আলাদা করে কোন প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়নি।

  • অনেক প্রযোজকরাই তাদের ছবির আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসেব প্রকাশ করতে চান না। আবার বক্স অফিস ব্যাপারটি কিন্তু অন্যান্য দেশে প্রযোজক সমিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ধরনের বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন আপনাদের হতে হবে বক্স অফিস প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে। এগুলো নিয়ে ভেবেছেন?

ভেবেছি। তাছাড়া প্রথম দিকে তো অনেক সমস্যা হবেই। ব্রিটিশরা যখন বাংলাদেশের মানুষকে প্রথম চা খাওয়াচ্ছিল, তখন কিন্তু ফ্রি খাওয়াচ্ছিল। তারপরে মানুষ যখন শিখে গেছে, তখন তো এটা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বক্স অফিস তো চলচ্চিত্রের মৌলিক চাহিদা। এটা ছাড়া তো চলচ্চিত্র পরিপূর্ণ হয় না। এটা তাদের বোঝাতে হবে। আমরা যদি বোঝাতে সক্ষম হই, অবশ্যই অবশ্যই সবাই আসবে।

  • আন্তর্জাতিক বক্স অফিসের নিয়ম অনুসারে প্রতিটি শোয়ের বিক্রয়ের হিসেব প্রকাশ করবেন, নাকি করবেন না?

আমরা চেষ্টা করবো দৈনিক, সাপ্তাহিক ও বাৎসরিক হিসেব প্রকাশ করার।

  • আর্থিক বিনিয়োগের পুরোটা কি আপনারাই করছেন, নাকি অন্য কেউ যুক্ত আছে?

আমরাই পুরোটা করছি।

  • সারাদেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়মে রুটসের ১০০টি শাখা দিবেন বলেছিলেন। এর জন্য ১ ও ১.৫ কোটি টাকার প্যাকেজও ঘোষণা করেছেন। এতে কেমন সাড়া ফেলেন?

অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে ২ জন, উল্লাপাড়া থেকে ১ জনের সঙ্গে কথা চূড়ান্ত হয়েছিল। আমাদের নিজেদেরই ময়মনসিংহে একটি শাখার কাজ চলছে। সেখানে এখনো ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি, তাই হলের কাজ শুরু করতে পারছি না। এছাড়া সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম থেকে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু আমরা নিজেরাই সবাইকে বলেছি, আপনি আরেকটু সময় নিন। কারণ, দেখুন আমরা যেটা করছি সেটা চ্যারিটি। রুটস প্রতি মাসে ৬৫-৭০ হাজার টাকা ড্যামারেজ দিচ্ছে। আমি তো আরেকজন মানুষকে সেটা বলতে পারি না। উনি তো ব্যবসার জন্য আসবে। আমরা সবাইকে বলে নিই দুবছর আপনাকে চ্যারিটি করতে হবে। তারপর আপনি দেখবেন উন্নতি হচ্ছে কিনা। কারণ, হল চলবে কিন্তু সামগ্রিক অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। বছরে ৫২ সপ্তাহ। দুই ঈদে দুই ছবি দিয়ে আপনি টিকবেন না। এটা দিয়ে বড়জোর দুমাস টিকবেন, বাকি দশ মাস কী করবেন? সিনেমা হলে তো আপনি অন্য কিছু চালাতে পারবেন না। আমার থেকে কেউ যদি শাখা নেয়, আমি লাভবান হবো। আমার পকেটে টাকা আসবে। আরেকটা মানুষকে কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি, এটা ভাবুন তো। ব্যবসা তো আমার উদ্দেশ্য না। ব্যবসা উদ্দেশ্য হলে তো আমি দেড় কোটি টাকা খরচ করে রুটস করতাম না, ব্যাংকে টাকা রাখতাম। আমি বক্স অফিস ও ই-টিকেটিংয়ের জন্য এখন পর্যন্ত সাড়ে ৩ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছি। আর একটা মানুষ যখন আসবে ওনাকে তো আমি আমার মতো ভাবতে পারি না। আমার পার্টনার ডাক্তার। উনি উপার্জন করেন, আমি হলের মধ্যে খরচ করি। সবাই তো এ জন্য আসবে না। চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে এর উন্নয়নের জন্য আসবে না। সে তো ব্যবসা করার জন্য করবে। দেখুন, আমি ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে করলে ৫০ আসনের হল করতাম। ২২ আসনের করতাম না। এটা করেছি, কারণ এখানে বসে আমি কাজ করবো। মানুষকে জানাবো এ জায়গায় বসে আমি কাজ করছি। এখান থেকে আস্তে আস্তে আগাবো।

  • গেল তিন বছরে ব্যবসায়িক হিসেবে আপনারা কি লাভে আছেন, নাকি লোকসানে?

এটা আসলে পাবলিক স্টেন্টিমেন্টের উপর নির্ভর করে। যেমন ‘হাওয়া’ যখন চলেছে আমরা তখন ভীষণ লাভ করেছি। এছাড়া ‘পরাণ’, ‘দিন দ্য ডে’, ‘জ্বীণ’—এ সিনেমাগুলোতেও অনেক লাভ করেছি। ‘তুফান’ নিয়ে একটা আশা আছে। ‘রাজকুমার’ অ্যাভারেজ ছিল। অন্যদের মত আমাদের হিসেব হবে না। অন্যরা টেবিল মানি দিয়ে সিনেমা নেয়। আমরা নিই বক্স অফিসের নিয়মে।

  • ‘তুফান’ নিয়ে অনেক প্রচারণা চালাচ্ছেন…

আমরা কিন্তু ‘রাজকুমার’-এর ক্ষেত্রেও প্রথম রোজা থেকে প্রচারণা চালিয়েছিলাম। তার আগে অবশ্য ‘সুড়ঙ্গ’ও করেছি।

  • আপনারা কি সব ছবির ক্ষেত্রে এমনটা করবেন?

হ্যাঁ, আমরা করি। আমাদের ইচ্ছে ‘জংলি’ যখন আসবে তখন কিছু আলাদা প্রমোশন করার ইচ্ছে আছে। ‘দরদ’ আসলে সেটার জন্যই করবো। যে সিনেমাটা আমাদের হলে আসে সেটা তো আমাদেরই সন্তান। গেলো ঈদে ১১ টা ছবির মধ্যে সবার আগে ‘রাজকুমার’ চালিয়েছি। এরপর একে একে ৮টা ছবি চালিয়েছি। কোরবানির ঈদ চলে আসায় বাকি ৩টি ছবি আনতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করি সবগুলো ছবি আমাদের হলে নিয়ে আসতে। সাধারণ মানুষ সবগুলো ছবির কাছাকাছি যেতে পারে।

  • সিরাজগঞ্জের চালায় এক সময় এক দিন আগে ছবি মুক্তি পেতো, যার সেল দেখে অন্য হল মালিকরা সিদ্ধান্ত নিত। আপনার জেলায় এখন হল নেই বললেই চলে। সে জায়গা থেকে মিনি সিনেপ্লেক্স করাটা একটা সাহসিকতার ব্যাপার। কিন্তু এ হল চালানোর পথটি নিশ্চয় মসৃণ ছিল না, অনেক বাধা এসেছে। এমন কিছু গল্প কি আমাদের পাঠকদের শোনাবেন, যা প্রকাশে আপনার কোন আপত্তি কিংবা সমস্যা হবে না।

আমি সবকিছুই পাবলিক করতে চাই। কারণ আমি এমন কিছু করি না যেটাতে আমার সমস্যা হবে। আমারো তো পরিবার রয়েছে। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার মা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি বড় হয়েছি রাজনৈতিক পরিবারে। আমার শ্বশুরবাড়িও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ জন্য আমাকে খুব বুঝে কাজ করতে হয়।

গত বার যখন ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘প্রিয়তমা’ এসেছিল তখন একটু ঝামেলা হয়েছিল। আমাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমি শুধু ডেস্কে বসে পড়তাম। কিন্তু কোথাও কোনো কমেন্ট করি নাই। আমার কিন্তু প্রথম পছন্দ ছিল ‘প্রিয়তমা’। ছবির ‘ঈশ্বর’ গানটা এত মারাত্মক ছিল! হিমেল ভাই শাকিব খানের যে লুকটা দিয়েছিলেন ওটা দেখে আমি নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। তার অনেক ফ্যান জানি। যখন ‘গলুই’, ‘বিদ্রোহী’ চালিয়েছি তখন কিন্তু কোনো দর্শক পাইনি। ‘প্রিয়তমা’-র একটা হাইপ উঠে গিয়েছিল। ওই সময় আমি যখন ছবিটা চাইলাম, ওনারা দিবেন না বক্স অফিসের নিয়মে—টেবিল মানি দাবি করলেন। কিন্তু আমরা এভাবে কোন সিনেমা নিবো না, এটা আমাদের জন্মগত নীতি। যার কারণে আমি ‘প্রিয়তমা’ আনতে পারি নাই। আমি ‘সুড়ঙ্গ’ টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, ওনারা আমাকে সম্মান দেখিয়ে বক্স অফিসের নিয়মে দিলেন।

তখন সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলাম নামক একজন নৃত্য পরিচালক, নিজেকে ডান্স মাস্টার পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই ভদ্রলোক ভাষাণী মিলনায়তন ভাড়া করে ‘প্রিয়তমা’ আনলেন। আমি নিজেও দুটো টিকেট নিয়েছিলাম পঞ্চম দিনের। উনি যখন চালাচ্ছিলেন তখন সম্ভবত কোনো সাংবাদিক আমাদের ডিসি স্যারকে ফোন দিয়েছিলেন। পৌরসভার মেয়রকেও ফোন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ভাষাণী মিলনায়তনে কীভাবে ছবি চলে। সিনেমা চালানোর যে নিয়ম, তা অনুযায়ী তো ওখানে চালানো যাবে না। হয় কোনো সিনেমা হলে চালাতে হবে। না হয় কোনো শিল্পকলায় চলচ্চিত্র উৎসব করা যেতে পারে। হলের বাইরে কোথাও সিনেমা চালানোর নিয়ম নেই।’ এটা যখন হয় মেয়র মহোদয় প্রদর্শনী বন্ধ করে দেন। আরশাদ আদনান মেয়রকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমার বাবা রাষ্ট্রপতি, এটা আমার সিনেমা। আমাকে পাঁচ দিনের অনুমতি দিন।‘ মেয়র তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। ছবিটা চলেছেও কিন্তু।

পাঁচ দিন পরে যখন বন্ধ করে দিয়েছে তখন সাইফুল ভাই বিভিন্ন প্রেসে ঘোষণা দিলেন, এটা আমি বন্ধ করে দিয়েছি। এসব শুনে আমি শুধু একটা জায়গায় বলেছিলাম, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির সন্তান আরশাদ আদনানের সিনেমা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা আদৌ কি আমার আছে?’ দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘কারো সিনেমা হলের যদি বৈধ কাগজ থাকে তাহলে তা বন্ধ করে দেওয়ার এখতিয়ার কি ডিসি প্রশাসনের আছে?’ দুটোর উত্তরই হচ্ছে, না। এ জায়গা থেকে আমি সাংগাতিক রকমের হ্যারাজমেন্টের শিকার হয়েছি। আমাকে বিভিন্নভাবে হেয় করা হয়েছে। কিছু ইউটিউব চ্যানেল, যারা কোন তথ্য আমার কাছ থেকে নেয়নি। আমার সাক্ষাৎকার বলে বিভিন্ন তথ্য ছেপে দিয়েছে, আমি জানিই না। এ ঘটনা আমাকে অনেক বেশি ম্যাচিউরড করেছে। আমি কোথাও কোনো উত্তর দেইনি, মন্তব্য করিনি। সহ্য করেছি, দেখেছি।

‘রাজকুমার’-এর সময়ও একই ঘটনা। উনাকে (সাইফুল ইসলাম) হল দেওয়া হয়নি বলে রুটসের সামনে এসে গালাগাল করে চলে গেছেন। আমার স্টাফরা আমাকে ঘটনাটি জানালে তাদের বলি, ‘এরপর এলে ওনাকে বসিয়ে কফি খাইয়ে বলবা—আপনি ওনাকে বলবেন। এত গরমে চিল্লাচিল্লি করে তো লাভ নেই।’ ‘প্রিয়তমা’র সময় বলেছিলাম, অবৈধ হলে যেন ছবিটা না চলে। তখন শাকিবিয়ানরা আমাকে খুব গালাগাল করেছিল। আমাকে জাজের দালাল, শাকিব খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে গালাগাল করেছিল। এবার যখন একই কথা বলছি, ওনারা আমাকে অনেক সম্মান করছেন।

  • আপনাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলবেন, দর্শকরা কেন ছবি দেখছে না। আর যেগুলো দেখছে সেগুলো কেন দেখছে?

কনটেন্ট ভালো হলে তো দর্শক আসে। ‘হাওয়া’র সময় আমার নিজের জন্য একমাস পরে টিকেট পেয়েছি। আমাদের অনুদানের কিছু সিনেমা আছে সেগুলো কেন মুক্তি দিচ্ছে, তা বুঝি না। আবার অনুদানের ‘১৯৭১ সেই সব দিন’, ‘দেয়ালের দেশ’—এগুলো কিন্তু মারাত্মক লেভেলের ভালো করেছে। দর্শককে হলে আনার জন্য শিল্পীদের ব্যক্তিত্বও জরুরি।

  • আপনি বলতে চাইছেন শিল্পীদের নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে সেগুলো দর্শকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করছে। কিন্তু এগুলো তো আগেও ছিল।

কেউ যখন কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতো সেটা সম্মানের সাথে নিত। এখন তো সম্মান ব্যাপারটা নাই। সিনিয়র-জুনিয়র কাউকে সম্মান করছে না। সাধারণ দর্শক এসে আমাকে বলে, ‘আপা। আপনাদের শিল্পী সমিতির চেয়ার নিয়ে যে এত টানাটানি ওনাদের তো সিনেমাই নাই! ওনারা সিনেমা করে না কেন?’ এটার কি কোনো উত্তর আছে আসলে আমাদের কাছে?

  • আপনাদের মতো সিনেপ্লেক্সগুলোর টিকেট ও খাবারের দাম অনেক বাড়তি। যার কারণে একজন ছাত্র বা সাধারণ মানুষের পক্ষে নিয়মিত ছবি দেখা সম্ভব হয় না।

এটা সত্য। যেমন সিরাজগঞ্জের প্রেক্ষাপটে আমাদের টিকেটের দাম ২০০-২৫০ টাকা। কিন্তু আমাদের যে সার্ভিস সেটা নিতে গেলে একটু তো দাম দিতে হবে। আমাদের পুরো হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কোনো শোতে যদি একজন দর্শকও থাকে, তার সঙ্গে আমাদের একজন স্টাফ বসে থাকে। স্কুল বা কলেজ ড্রেস পরে যদি কেউ আসে, আমরা কিন্তু তাদের কাছে টিকেট বিক্রি করি না। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে কেউ হলে ঢুকতে পারবে না। আমি নিজে এটা মনিটরিং করি। আমরা খাবারগুলো হলের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছি। এ যে সার্ভিসগুলো—সে অনুযায়ী ২০০ টাকা কমই নিচ্ছি। আমাদের এখানে অনেক রিকশাওলারা আসে। তাদের সম্মানার্থে মাঝে মাঝে কিছুটা ছাড় দিই। অরুণা বিশ্বাস খালামণির সিনেমা ‘অসম্ভব’ চলছিল, তখন একজন রিকশাওলা এসেছিলেন। ভদ্রলোক সম্ভবতো অরুণা বিশ্বাসের বাবা যখন এখানে মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন তখন দেখেছিলেন। উনি যখন এ পরিচয়টা দিলেন তখন ওনাকে আমরা টিকেট ফ্রি করে দিয়েছি। খাবার খাইয়েছি। যাওয়ার সময় ওনার সঙ্গে ছবি তুলেছি। সে ছবি পরে এসে উনি প্রিন্ট করে নিয়ে গেছেন। এ জিনিসগুলো আমরা চেষ্টা করি। কোয়ালিটি ধরে রাখতে গেলে একটু খরচ তো আমাদেরকেও দিতে হয়।

  • ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও চলচ্চিত্র প্রযোজনা—ব্যাপারগুলো কতদূর এগোলো?

আমার যিনি পার্টনার উনি চিত্রনাট্য লিখছেন। এটা হয়ে গেলে আমরা প্রযোজনায় আসবো। ওটিটিতেও আসার ইচ্ছে আছে। একটা একটা করে গুছিয়ে না আসলে সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে। মানুষ তো আমরা দুজন।

  • আপনাদের ছবির পরিচালক কি রায়হান রাফি?

এটা তো এখনই বলতে পারছি না। স্ক্রিপ্টটা দাঁড়াক। কেন আপনার মনে হলো রাফির কথা?

  • আপনারা তার সঙ্গে অনেকবার মিটিং করেছেন।

আমি হিমেল (হিমেল আশরাফ) ভাই, সুমন (খন্দকার সুমন) ভাইয়ের সঙ্গে মিটিং করেছি। খিজির হায়াত ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় নিয়মিত। আমার সঙ্গে অনেকের কথা হয়, ভাইয়া।

  • কথা হওয়া আর সিনেমা নিয়ে মিটিং হওয়া তো এক না। আমরা তো জানি রাফির সঙ্গে আপনাদের কথা অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা কি তাহলে ভুল জানি?

এটা আপনাকে যে জানিয়েছে সে ঠিক জানায়নি। আমি যখন আপনাকে জানাবো তখন সেটা সত্য।

  • আর বাকি সব গুঞ্জন!

হতে পারে। রাফির সঙ্গে তো ‘সুড়ঙ্গ’, ‘দামাল’-এর সময় দেখা হয়েছে। ওর অফিসে আমি অনেকবার গিয়েছি। সেটা বন্ধুসুলভ আড্ডা। যেমন, ‘তুফান’ নিয়ে ওর সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে। আমাদের সিনেমার পরিচালক রাফি হবে এরকম কোনো কথা হয়নি। তবে হ্যাঁ আমরা যে সিনেমা প্রযোজনা করবো এটা রাফি জানে। শুধু সে না আরও অনেকেই জানেন। অনেক কলাকুশলীও জানেন। এটা নিশোও (আফরান নিশো) জানে। রাফিকে আসলে আমরা কোনো প্রস্তাব দিই নাই। তবে সে নিজেকে যেভাবে প্রমাণ করছে আমরা তাকে নিয়ে ভাবতেও পারি।

  • হল মালিকরা সবাই হিন্দি ছবি আমদানির পক্ষে। হিন্দি ছবি কি আপনাদের হলগুলো টিকিয়ে রাখতে পারবে?

হল টিকিয়ে রাখতে পারবে দর্শক। আমাদের এখানে হিন্দি ‘পাঠান’, ‘জাওয়ান’, ‘ডানকি’, ‘অ্যানিমেল’ ও ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মাহি’ চলছে। ‘কিসি কা ভাই কিসি কি জান’ ও ‘ফাইটার’ ছাড়া সব হিন্দি ছবিই চলেছে। ছবিগুলোতে আমাদের কোনো লোকসান হয়নি। ‘জাওয়ান’-এর টিকেট বিক্রি করে আমাদের ১ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। ‘পাঠান’ থেকে লাভ করেছি। ‘ডানকি’ থেকে এভারেজ বিজনেস করেছি। এমনও হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো এক সিনেমার পুরো সপ্তাহে দুটা টিকেট বিক্রি হয়েছে, নাম বলছি না সঙ্গত কারণেই। কিন্তু ওনাকে আমরা ১ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি।

হিন্দি ছবিতে আমাদের কখনই কোনো শো ফাঁকা যায়নি। ২,৪ কিংবা ৫ জন হোক দর্শক থাকে। হিন্দি সিনেমা আমাদের চলচ্চিত্র বাঁচাবে না সত্য। কিন্তু হিন্দি সিনেমা চালিয়ে অন্তত বিদ্যুৎ বিলটা তুলতে পারি। যখন আমরা দেখবো বাংলাদেশে প্রচুর ভালো সিনেমা হচ্ছে, তখন আমি নিজেই বলবো—দরকার নেই অন্য সিনেমার, বাংলা সিনেমা চলুক। কিন্তু যেখানে কিছুই নেই সেখানে যদি অন্য একটা সিনেমা এসে আমাদের দর্শকদের হলে আসার অভ্যাসটা তৈরি করতে পারে, সেটা তো ভালো। হিন্দি সিনেমা যদি প্রতি সপ্তাহে এসে, তাহলে তো একটা অভ্যাস তৈরি হলো। ঈদের দর্শক তো উৎসবের দর্শক, উনি তো নিয়মিত দর্শক না।

  • সরকার সিনেমা হল নির্মাণের জন্য যে বিশেষ ঋণ দিচ্ছে, সেখানে কি আপনারা আবেদন করেছেন?

না, আমরা এখনো আবেদন করিনি।

  • কেন করেননি?

আমরা দুটো ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কিন্তু তারা যে শর্তের কথা জানিয়েছে, সেগুলো আমাদের কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে। এবং ওনারা যেটা দাবি করছেন, সেটা যদি একজন হল মালিক দিতে পারে, তাহলে তো আমাদের ঋণের প্রয়োজন হয় না। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এ প্রণোদনার মধ্যে অসংখ্য জটিলতা রয়েছে।

সারাবাংলা/এজেডএস/এএসজি

Scroll to Top