মিরাজ রহমান
কোরবানি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই প্রবর্তিত। আমাদের অর্থবিত্ত, সংসার এবং সমাজ তার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। কোরবানি হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীকমাত্র। কোরবানির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে কিনা, সেটিই পরীক্ষার বিষয়। কোরবানি আমাদেরকে সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল সেটাই। আমাদেরকে এখন আর পুত্র কোরবানি দেওয়ার মতো অতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। কেবল একটি মুসিন্নাহ তথা জবাইয়ের উপযুক্ত হালাল পশু কোরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। ইমানের এসব কঠিন পরীক্ষায় যারা যতো বেশি নম্বর অর্জন করতে পারেন, তারাই হন ততো বড় আল্লাহপ্রেমিক ও আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ততোই সফল। ইদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক আনন্দ তারা ঠিক ততোটাই উপভোগ করতে পারেন, যতোটা তারা এ জাতীয় পরীক্ষায় সফল হন।
কোরবানি আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতার মাধ্যম
কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তার সওয়াব লেখা হয়। আল্লাহর কাছে কোরবানির সওয়াব গ্রহণীয় হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, পূর্ণ ইমান ও ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বীয় প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের কাঁধে ছুরি চালিয়েছিলেন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময় কোরবানিদাতার মনটা সেই মানসিকতা ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে। আর যদি তার দেহমনের পরতে পরতে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহলে তার এই কোরবানির উৎসব নিছক গোশত খাওয়ার জন্যই হবে। সেজন্যই আল্লাহতায়ালা কোরবানিদাতাদের সাবধান করে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তার কাছে পৌঁছোয় কেবল তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)।
কোরবানি আত্মত্যাগের অনন্য উপমা
কোরবানি কেবল পশু জবাই করার নাম নয়। নিজের পশুত্ব, ক্ষুদ্রতা, নীচুতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহঙ্কার ত্যাগের নাম কোরবানি। নিজের নামাজ, কোরবানি, জীবন-মরণ ও যাবতীয় বিষয়-আশয় সবকিছুই কেবল আল্লাহর নামে তারই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানসিকতা এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কোরবানি। এই কোরবানি পশু জবাই থেকে আরম্ভ করে নিজের ভেতরকার পশুত্ব জবাই বা বিসর্জন এবং আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে তার পথে শাহাদত বরণ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। এই কোরবানি মানুষের আকাঙ্খা, নিয়ত, প্রস্তুতি ও গভীরতম প্রতিশ্রুতি থেকে আরম্ভ করে তার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্প্রসারিত। মূলত কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীকি ব্যাপার। আল্লাহর জন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি উপমামাত্র। কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় নিজ সম্পদ অন্যের কল্যাণে ব্যয় করার মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কোরবানি স্বার্থক হয়েছে। আর না হয় এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল। এজন্য রাব্বুল আলামিন কোরআনে কারিমে বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কোরবানিকে উল্লেখ করেছেন ত্যাগের নিদর্শনরূপে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তোমাদের জন্য কোরবানির উটসমূহকে আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম করেছি। যাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান পশুগুলির ওপর তোমরা আল্লাহর স্মরণ (বিসমিল্লাহ বলে কোরবানি) করো। আর যখন কাৎ হয়ে পড়ে, তখন সেগুলো থেকে খাও। আর আহার করাও ধৈর্য্যশীল অভাবী ও ভিক্ষাকারী অভাবগ্রস্তকে। এভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যেনো তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা হজ : ৩৬)।
চিত্ত-বিত্তের মেলবন্ধনের নাম কোরবানি
কোরবানির গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। যতোটুকু যায় বা রেকর্ড হয়ে থাকে, তা হলো আমাদের মনে তার প্রেমের গভীরতার মাত্রা। কোরবানির গোশত গরিবদের জন্য যতোটুকু সম্ভব বিলিয়ে দেওয়া চাই। কেবল সেটাই পরকালে আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। আর যাকে আমরা আমাদের অংশ মনে করে কৃপণের ধনের মতো আঁকড়ে আছি, সেটাই বরং আমাদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, যে বিষয়ে আমরা একেবারেই বেখবর। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদারগণ, যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছো এবং যা কিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য ফলিয়েছি, তা থেকে উত্তম অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো।’ (সুরা বাকারা : ২৬৭)। কাজেই আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবসেবায় ব্যয় করা চাই। গরিব মানুষের সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি সকল বিত্তশালী লোকের এগিয়ে আসা উচিত। সারা জীবন সাধ্যমতো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের কথা বিবেচনা করে মানুষকে সাহায্য করা দরকার। চিত্ত আর বিত্তের মিল ঘটানোর জন্যই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বারবার মানুষকে আহ্বান করেছেন।
কোরবানি নিছক কোনও উৎসব নয়
কোরবানি নিছক কোনো লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কোরবানিতে যদি আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে, তাহলে এই সুবর্ণ সুযোগ বিফলে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হবে না। আমাদের সমাজে আজ অনেককে বড় বড় পশু কিনে প্রদর্শন কিংবা বাহাদুরি জাহির করতে দেখা যায়। আবার অনেককে দেখা যায় গরিব-মিসকিনদের যথাযথভাবে গোশত না দিয়ে ইদের দিন নিজেরা সামান্য গোশত রান্না করে বাকিটা ফ্রিজে রেখে দেয়। সারা বছর তারা উল্লাস করে অল্প অল্প করে নিজেরা খায়। এসব কোনোমতেই প্রকৃত কোরবানির পর্যায়ে পড়ে না। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বড় বড় গরু কিনে প্রদর্শন ও বাহাদুরি জাহির করলে অথবা গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করলে কোরবানি কবুল হবে না। তা কেবল পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এসব পশুর রক্ত, গোশত যেমন আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তেমনি গ্রহণযোগ্যতাও পায় না এগুলোর কোরবানি। হালাল উপার্জন, ইখলাস ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। কে কতো টাকা দিয়ে পশু কিনলো, কার পশুটি কতো মোটা তাজা বা সুন্দর, আল্লাহতায়ালা তা দেখেন না। তিনি দেখেন বিশুদ্ধ নিয়ত ও তাকওয়া। মূলত আল্লাহর পথে জীবনোৎসর্গ করার আগ্রহ সৃষ্টি করা, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পুত্র কোরবানির মতো ত্যাগপূর্ণ আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তার বড়ত্ব প্রকাশ করাই ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য।
পশু কোরবানি বিশ্বাসের স্বীকৃতিস্বরূপ
কোরবানি শিরক থেকে মুক্ত থাকার একটি কার্যকরী মাধ্যম। ইসলামে মুসলমানদেরকে কোরবানির বিধান দিয়ে তাওহিদ তথা একত্ববাদের বিশ্বাসকে উজ্জ্বল ও দৃঢ় করার পাশাপাশি এই শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে, এসব সৃষ্টি করা হয়েছে কোরবানি করে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন তাওহিদের বিশ্বাস শাণিত হয়, তেমনি মানুষকে ইসলামের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। তাই কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের বিবেককে জাগিয়ে তোলা বড় প্রয়োজন। তাছাড়া কোরবানি করার মাধ্যমে সবাই আল্লাহতায়ালার ক্ষমতা ও আধিপত্য দৃঢ় মনে মেনে নেওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। এর মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়। মুসলমান বিশ্বাস করে থাকে, আল্লাহই হলেন বিশ্বজাহানের স্রষ্ট্রা ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এসব পশু তারই। পশু কোরবানি সেই বিশ্বাসের স্বীকৃতিস্বরূপ।
কোরবানি সামাজিক ও পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম
কোরবানির মাধ্যমে সামাজিক ও পারিবারিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রেরণা তৈরি হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০৩)। কোরবানির গোশত দ্বারা উত্তম পানাহারের মাধ্যমে ইমানদারদের মাঝে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়। কোরবানিতে গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়। যারা বছরে একবারও গোশত খেতে পারে না, তারাও গোশত খাওয়ার সুযোগ লাভ করে। দারিদ্র বিমোচনেও এর গুরুত্ব রয়েছে। কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থ গরিবের মাঝে বণ্টন করার মাধ্যমে গরিব-দুঃখী মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। অপরদিকে কোরবানির পশুর চামড়া অর্থনীতিতে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। সর্বোপরি কোরবানি করার মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহের স্মরণ ও তার বড়ত্ব প্রকাশ করা হয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, ইসলাম প্রতিদিন
সারাবাংলা/এসবিডিই