ঈদের নাটকঃ অতীত- বর্তমান – আনন্দ আলো

ঈদের নাটকঃ অতীত- বর্তমান – আনন্দ আলো

দেশের শহর, বন্দর, গ্রামের রাস্তা ফাঁকা। কেন? বিটিভিতে ঈদের বিশেষ নাটক প্রচার হবে। যে কোনো ভাবেই হোক নাটকটি দেখতে হবে। দেশের প্রতিটি অগ্রসরমান পরিবারে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। গৃহিনীরা আগে ভাগেই ‘রান্না—বান্নার’ কাজ শেষ করে ফেলেন। পরিবারের সব সদস্যই একটি টেলিভিশন সেটের সামনে এসে বসেন। এই টেলিভিশন সেটটি পরিবারের সকল সদস্যের অনেক প্রিয়। নাটক, সিনেমা, খবর, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখার একমাত্র বাহন। এক সময় গ্রামে, মফস্বল শহরে এমন কী ঢাকা শহরেও অনেক পরিবারে ড্রয়িংরুম আর ড্রয়িং রুমে রাখা টেলিভিশন সেটটির প্রতিই সবার আগ্রহ ছিল বেশি। ঈদের বিশেষ দিনগুলোতে ড্রয়িংরুম অর্থাৎ টিভিরুম অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো। প্রায় সারাদিন, সারাক্ষণ টিভি অন করা থাকতো। কখন কোন অনুষ্ঠান প্রচার হবে তার একটা তালিকা তৈরি করে ড্রয়িংরুমের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা হতো। ঈদের বিশেষ নাটকের প্রতিই ছিল সবার আগ্রহ। প্রয়াত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা নাট্যকার আমজাদ হোসেন বিটিভিতে ঈদের দিনের বিশেষ নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন। এই নাটকে জব্বর আলী নামে একটি গুরুত্বপুর্ন চরিত্রে অভিনয় করতেন আমজাদ হোসেন। প্রতি ঈদে সম—সাময়িক ঘটনা নিয়ে নাটকটি লেখা হতো। এই নাটকের অনেক সংলাপ এখনও প্রবীণদের কাছে স্মৃতি হয়ে আছে। ‘টাকা দেন দুবাই যামু’ এই একটি সংলাপ এখনও অনেকের আনন্দ স্মৃতিতে টোকা দেয়। নাটকে জব্বর আলীকে দেখার জন্যই দেশের শহর—বন্দর গ্রামের রাস্তা ঘাট ফাঁকা হয়ে যেত।

সম্পর্কিত

একটা সময় ঈদের নাটকের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। বলা বাহুল্য বাংলাদেশে টিভি নাটকের ক্ষেত্রেও একটা বিরাট পরিবর্তন এনেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বিটিভিতে ঈদের বিশেষ নাটক মানেই হুমায়ূন আহমেদের নাটক। সারাদেশের মানুষ অপেক্ষার প্রহর গুণতেন কখন নাটক প্রচার হবে। ঈদের বিশেষ নাটক প্রচার হওয়ার পরপরই সারাদেশে আলোচনা—সমালোচনা শুরু হয়ে যেত। কে ভালো করেছেন, কার অভিনয় দারুণ হয়েছে, কার অভিনয় আরেকটু ভালো হতে পারতো… এই নিয়ে কত আলোচনা, কত কথা। খাবার টেবিলে, পারিবারিক আড্ডায়, অফিস আদালতে, রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানের আড্ডায়, ক্যাম্পাসে ছাত্র—ছাত্রীদের মধ্যে একটাই আলোচনা গুরুত্ব পেত। সেটা হল ঈদের নাটক। এই আলোচনা চলতো অনেক দিন। পত্র—পত্রিকায় ঈদের নাটক নিয়ে সমালোচনা প্রকাশ করা হতো। এমনও হয়েছে ঈদের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই অনেক নতুন অভিনয় শিল্পী রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে যেতেন।

কিন্তু বিটিভির বাইরে একে একে বেসরকারী টিভি চ্যানেলের আবির্ভাব ঘটতে থাকলো। ফলে শুধুমাত্র একটি টিভি চ্যানেলের প্রতিও দর্শকদের আস্থা, ঝোক কমতে শুরু করলো। বিটিভি যুগে বিকল্প ভাবনার সুযোগ ছিল না। কিন্তু একে একে বেসরকারী টেলিভিশনের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকায় দর্শক বিকল্প পথ খুঁজে পেল। এক সময় যুক্ত হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। হাতের মুঠোয় চলে এলো বিনোদন। একটি মোবাইল ফোনই যেন হয়ে উঠলো এক একটি টেলিভিশন চ্যানেল। ফলে বিটিভি যুগে টিভি নাটকের প্রতি দর্শকদের যে টান ছিল সেটা কমতে শুরু করলো। অর্থাৎ টেলিভিশনেই নাটক দেখতে হবে এমন ভাবনার পরিবর্তন ঘটলো। বর্তমান সময়ে দেশের প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলে ৫ দিন, ৭দিন ব্যাপি ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন থাকে। আরও থাকে ৭দিন ব্যাপি বিশেষ নাটকের প্রচার। যাকে বলা হয় ঈদের সিরিজ নাটক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টেলিভিশনে প্রচারিত ঈদের নাটক সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা হয়। ইউটিউব—এ নাটক দেখার প্রবণতা বাড়ছে। এক্ষেত্রে দর্শকদের মন্তব্য নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সময় বের করে ইউটিউব এ নাটক দেখা যায়। তাই টেলিভিশন চ্যানেলে অন এয়ারের সময় অনেকেই নাটক দেখার আগ্রহ পান না। উপরুন্তু নাটক বা অনুষ্ঠান প্রচারের সময় অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচারকেও বিরক্তির কারণ বলে উল্লেখ করে অনেকে মন্তব্য করলেন, একথা সত্য বিজ্ঞাপন প্রচার ছাড়া টিভি চ্যানেল গুলোর টিকে থাকা কঠিন। তাই বলে একটি অনুষ্ঠানের ভেতর কত মিনিট বিজ্ঞাপন থাকবে সেটা বোধকরি বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন আছে। কারণ একাধিক অপশন থাকায় বর্তমান সময়ের টিভি দর্শক বেশ অস্থির। কোনো টিভি চ্যানেলের অনু্ষ্ঠান পছন্দ হচ্ছে না, অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার যন্ত্রনা দিচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ওই টিভি চ্যানেল থেকে সরে যায় অনেক দর্শক। কাজেই শুধু ঈদের নাটক নয় অন্যসময়েও নাটক বা অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে টিভি চ্যানেল গুলোর উচিৎ সময়কে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

একটা সময় ছিল যখন শুধু আমাদের দেশেই নয় গোটা পৃথিবীতে সিনেমাই ছিল সব চেয়ে বড় বিনোদন মাধ্যম। সিনেমার প্রতি ছিল মানুষের দুনির্বার আকর্ষণ। হলের ভিতর সাদা পর্দায় মানুষ হাঁটে, দৌড়ায়, হাসে, কাঁদে। জীবনের কথা উঠে আসে বড় পর্দায়। এ যেন এক অবাক করা জাদু। দেখলেই মনে প্রশান্তি আসে। আনন্দে মন ভরে যায়। তাই কর্মক্লান্ত মানুষ, বিনোদন পিয়াসী মানুষের একমাত্র আগ্রহের জায়গা হয়ে ওঠে সিনেমা হল। নতুন সিনেমা মুক্তি মানেই উৎসব আনন্দের ঢেউ জেগে ওঠা। প্রতিটি অগ্রসরমান পরিবারে তখনকার দিনে সিনেমা দেখাই ছিল প্রধান বিনোদন। তাও আবার রীতিমত পরিকল্পনা সাজিয়ে পরিবারের লোকজন সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতেন। সিনেমা দেখে ফিরে এসে পারিবারিক আড্ডায় সিনেমার ভালো—মন্দ নিয়ে আলোচনা চলত। আর যদি সিনেমাটি মনের মতো হয় তাহলে তো মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত সিনেমাটির নাম। বাসা বাড়ি থেকে অফিস আদালতের আড্ডায়ও ভালো সিনেমাটি নিয়ে কথা হতো। ‘আহা! কী দারুন সিনেমা! রাজ্জাকের অভিনয় দেখেছেন। আর কবরীর তো জুড়ি নেই। আনোয়ার হোসেন আর রোজী সামাদ তো ফাটিয়ে দিয়েছে.’ এ ধরনের কত কথাই না আলোচিত হতো। পরিবারের মানুষেরা সিনেমার নায়ক—নায়িকার নাম ধরে এমন ভাবে আলোচনা—সমালোচনা করতেন মনে হতো সিনেমার রাজ্জাক, ববিতা, শাবানা, ফারুক, আলমগীর, কবরী, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, আনোয়ারা তাদের পরিবারেই সদস্য অথবা কতদিনেরই না চেনা। প্রিয় অভিনেতার টানে এক সিনেমা অনেকেই একাধিকবার দেখতে যেতেন। বিনোদন পত্রিকার পাতায় ছাপা হতো নায়ক—নায়িকাদের বড় বড় ছবি। আর এই ছবিগুলো সংগ্রহ করে অনেক ভক্ত তার শোবার ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখতেন। এরকম কতো ভক্তের খবরই না পাওয়া যেত। নায়করাজ রাজ্জাকের ছোট বড় নানা ধরনের ছবি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে নিজের থাকার ঘরের দেয়াল। কবরী, ববিতার ছবি দিয়েও ছবির জাদুঘর সাজানোর কত ঘটনাই না ঘটেছে। সিনেমার নায়ক নায়িকারা ছিল অনেকের কাছে দেবতার মতো! তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারলেই যেন জীবন ধন্য।

কালের বিবর্তণে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম টেলিভিশন বিস্তৃত আকার ধারণ করলো। আমাদের দেশে টেলিভিশন মানেই ছিল একটি মাত্র নাম বিটিভি। সিনেমার মতোই ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল বিটিভি। বিটিভিতে প্রতি সপ্তাহে এক ঘণ্টার একটি নাটক প্রচার হতো। নাটকের এই অনুষ্ঠানটি ছিল বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। রাতে অর্থাৎ সন্ধ্যার পরই প্রচার হতো এক ঘণ্টার নাটক। তখন তো আর মোবাইলের যুগ ছিল না। তবুও নাটক প্রচারের পর—পরই বাতাসের বেগে ছড়িয়ে যেতো নাটকটির ভালোমন্দের অনুভূতি। পরের দিন বিভিনড়ব অফিস আদালতেও আলোচনার ঝড় তুলতো ওই নাটকটি। ফলে নতুন কোনো অভিনেতা, অভিনেত্রী একটি নাটকে ভালো অভিনয় করলেই হয়ে যেতো স্টার। পত্র—পত্রিকায় তাকে ঘিরে তোলপাড় শুরু হতো। এক সময় সিনেমার জনপ্রিয়তা ভাগাভাগি হয়ে যায় টেলিভিশনের পর্দায়। কালের বিবর্তণে টেলিভিশনের জনপ্রিয়তাও হ্রাস পেতে থাকলো। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবির্ভাবে সিনেমা হলের প্রতি মানুষের সীমাহীন আগ্রহে যেন কমে যেতে শুরু করলো। এর কারণ হলো তথ্য প্রযুক্তির আধুনিক আবিস্কার। আগে সিনেমা দেখতে হলে দল বেধে হলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। টেলিভিশনের যুগান্তকারী প্রসারের ফলে টেলিভিশনে অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সিনেমাও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। অর্থাৎ এক সময় সিনেমা দেখতে হলে যেতে হতো সিনেমা হলে। পরে সেই সিনেমাই দেখার সুযোগ মিলল ঘরের ড্রয়িংরুমে টেলিভিশনের পর্দায়। ফলে সিনেমা হলের প্রতি সাধারণ দর্শকের আগ্রহ যেন কমে যেতে থাকল। যেখানে ঘরে বসেই টিভিতে সিনেমা দেখা যায় সেখানে কষ্ট করে সিনেমা হলে যাবারই বা দরকার কী?

ঈদ ধারাবাহিক
ঈদে ইদানিং ধারাবাহিক নাটক প্রচারের উদ্যোগও শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রেও পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে চ্যানেল আই। ফরিদুর রেজা সাগরের ছোটকাকু সিরিজ অবলম্বনে নন্দিত নির্মাতা আফজাল হোসেন প্রতি ঈদেই ছোটকাকুকে ঘিরে ঈদ ধারাবাহিক নির্মাণ করে চলেছেন। ছোটকাকুর অনুপ্রেরণায় দেশের অন্যান্য টিভি চ্যানেলও ঈদ ধারাবাহিক নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

আবার এক সময় হঠাৎ করেই সিনেমা দেখার সুযোগ মিলল মোবাইল ফোনের পর্দায়। শুধু কী সিনেমা? টিভি নাটক সহ আরও কত কিছুই না এখন মোবাইল ফোনের পর্দায় দেখা যায়। ফলে নাটক সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটলো। এক সময় সিনেমা হল ছিল বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ। পরে সেটা চলে এলো পরিবারের ড্রয়িংরুমে। এখন মোবাইল ফোনের পর্দায় সিনেমা, নাটক দেখার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে হেঁটে হেঁটে, গাড়িতে যেতে যেতে এমনকি বিছানায় শুয়েও মানুষ নাটক, সিনেমা দেখে। ফলে বিনোদনের ক্ষেত্র অনেকটাই বদলে গেছে! কিন্তু কাঙ্খিত পরিবর্তনটাই বা কী হলো? নাটক, সিনেমাসহ বিনোদনের অনেক কিছুই এখন মোবাইল ফোনে দেখার সুযোগ রয়েছে। তা সত্বেও আমাদের নাটক, সিনেমা নিয়ে অতীতকালের মতো কেন ‘ভালো’ আলোচনা হয় না? এখন তো আর যানজট অতিক্রম করে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা না দেখলেও চলে। ইউটিউবে ঢুকলেই সিনেমার বিরাট রাজ্য স্বাগত জানাবে। হাতের কাছে কতই না সুযোগ। কিন্তু আমরা কি সেই সুযোগ পজিটিভ অর্থে গ্রহণ করছি? সেকাল আর একালের কত ব্যবধান!

সময় কত দ্রুত বদলায়। ঈদ উদযাপনের কথাই যদি বলি, ২০/২৫ বছর আগের ঈদ আর বর্তমান সময়ের ঈদ উৎসবের মধ্যে আকাশ—পাতাল পার্থক্য। অতীতকালের ঈদ উৎসবে আনন্দের একমাত্র উৎস ছিল পারস্পারিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ। এবাড়ি ওবাড়ি ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার মধুরতম স্মৃতি পুরনো মানুষের মনে এখনও উজ্জ্বল। ঈদ উপলক্ষে নাড়ীর টানে শহর থেকে গ্রামে যারা বেড়াতে যেতেন তারা গ্রামে অন্য রকম আনন্দ ছড়াতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতেন প্রিয়জনদের সঙ্গে। গ্রামে সব বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। তবে শহরে সন্ধ্যার পর টিভি অনুষ্ঠান দেখা ছিল ঈদ উৎসবের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। বিটিভি ছিল একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল। বিটিভির নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান পরিবারের সদস্যরা একজোট হয়ে দেখতেন। বিশেষ করে বিটিভির ঈদের নাটক ছিল সকলের আগ্রহের বিষয়। ঈদের বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখার জন্য অনেকে আগে থেকেই সময় বের করে রাখতেন। বিটিভিতে ঈদের নাটক যখন প্রচার হতো তখন রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। নাটক প্রচারের পর তার ভালো—মন্দ নিয়ে চলতো চুলচেরা বিশ্লেষন। বাসা বাড়িতে তো বটেই অফিস আদালতের আড্ডায়ও ঈদের নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঢেউ খেলে যেত। ঈদে অগ্রসরমান পরিবারের বিশেষ আগ্রহ ছিল বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যার ওপর। সেই সময় বিচিত্রার কদর ছিল অনেক বেশী। পরবর্তিতে অন্যদিন, আনন্দ আলোসহ আরও কিছু পত্রিকার ঈদ সংখ্যা ঈদের অন্যতম আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘এক ব্যাগ আনন্দ এক ব্যাগ আলো’ শীর্ষক ঈদ সংখ্যার প্রচলন করেছিল আনন্দ আলো। একটি ব্যাগে ১০/১২টি পত্রিকা এক সঙ্গে প্রকাশ হতো। পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ ও ভালোবাসা পেয়েছে আনন্দ আলো।

অতীতকালে ঈদ আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল সিনেমা। ঈদে নতুন সিনেমা মুক্তির লড়াই শুরু হতো। পারিবারিকভাবে দল বেঁধে সবাই সিনেমা হলে যেতেন। টিকিট পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। সিনেমার টিকিট ব্লাকে বিক্রি হতো। ফলে নতুন সিনেমার টিকিট পাওয়া নিয়ে অনেক দৌড়ঝাপ করতে হতো। সিনেমার পাশাপাশি গান ছিল ঈদের অন্যতম আনন্দ উপভোগের অনুষঙ্গ। নতুন সিনেমার মতো নতুন গানের ক্যাসেট রিলিজ হতো। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীর নতুন গানের ক্যাসেট নিমিষেই বিক্রি হয়ে যেত। ঈদেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতো অনেক গান। ঈদের সিনেমা হিট মানেই সিনেমার পালে নতুন হাওয়া। ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত গল্প উপন্যাসই পরবর্তিতে বইমেলায় নতুন বইয়ের আকার পেত। ফলে ঈদকে কেন্দ্র করে শিল্প, সাহিত্য—সংস্কৃতির অনেক কিছুই পরবর্তি সময়ে বিকাশ লাভ করতো।

ঈদের নাটক জনপ্রিয় হলে ওই নাট্যকার পরিচালকের প্রতি আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হতো সবার। ঈদের সিনেমা জনপ্রিয় হলেই ওই সিনেমার পরিচালকের কদর বেড়ে যেতো। ঈদ সংখ্যার কোনো গল্প উপন্যাস আলোচনায় উঠে আসা মানেই সংশ্লিষ্ট লেখকের প্রতি প্রকাশকদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়া। মোট কথা ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, এমনকি ব্যবসার গতিপথও বদলে যেত। নতুন পোশাক ঈদ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ, ঈদে ধনী গরীব নির্বিশেষে ঈদের নতুন পোশাক কেনা চাই—ই চাই। ফলে ঈদের আনন্দে পোশাক হয়ে উঠতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এখনও নতুন পোশাকের গুরুত্ব রয়েই গেছে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে একটু যেন পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনটা এনেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন শাখা দিয়েছে ঈদ উৎসবের প্রচলিত ধারনা। সিনেমার কথাই যদি বলি। ফেসবুকে, ইউটিউবে, ওটিটি চ্যানেলে কোন সিনেমা দেখতে চান আপনি? দেশী—বিদেশী কোন সিনেমা আপনার দরকার? সিনেমা হলে যেতে হবে না। আপনি যেখানেই থাকেন না কেন আপনার হাতে যদি থাকে একটি মোবাইল ফোন, আর যদি ওই ফোনে থাকে ইন্টারনেট কানেকশন তাহলে পৃথিবীতো আপনার হাতের মুঠোয়। শুধু ইচ্ছে প্রকাশ করুন। যাদুর কাঠির স্পর্শে নিমিষেই হাজির হবে কাঙ্খিত সিনেমা, টিভি নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, প্রিয় কবি লেখকের জনপ্রিয় সেই কবিতা অথবা উপন্যাস। জনপ্রিয় সেই গানটি শুনতে চান? তাও পাবেন নিমিষে। অথচ একটা সময় এই বিষয় গুলো পাওয়ার জন্য দেখার জন্য, পড়ার জন্য আপনাকে বাড়ির বাইরে নানান জায়গায় যেতে হয়েছে। সিনেমা দেখার জন্য যেতে হয়েছে সিনেমা হলে। টিভি নাটক দেখার জন্য যেতে হয়েছে বাসার ড্রয়িং রুমে। গল্প, উপন্যাস পড়ার জন্য সংগ্রহ করতে হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। নতুন গান শোনার জন্য সংগ্রহ করতে হয়েছে গানের নতুন সিডি অথবা ক্যাসেট। আর এখন সব কিছুই  পাওয়া যায় মোবাইল ফোনে। গান, নাটক, সিনেমা, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, খাবার দাবার, পোশাক, প্রশাধনী থেকে সব কিছুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই পাওয়া যায়। এমনকি ঈদে বাড়ি যাবেন রেল, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, উড়োজাহাজের টিকিটও পেয়ে যাবেন অনলাইনে।

ফলে ঈদের অতীত ও বর্তমানের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। একটা সময় ঈদের নতুন পোশাক কেনার জন্য দর্জি বাড়িতে যেতে হতো। দর্জি শরীরের মাপ নিতেন। সেই মাপ অনুযায়ী পোশাক বানাতেন। এখন আর দর্জি বাড়ি যেতে হয় না। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস ও পোশাক প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানে ঢু মারলে পাওয়া যায় পছন্দের পোশাক। কাজেই কে যায় আর দর্জি বাড়ি? পোশাকের সুরাহা হল। নাড়ীর টানে গ্রামে যাবেন। বাস, লঞ্চ, ট্রেন উড়োজাহাজের টিকিট চাই। একটা সময় বাস, লঞ্চ, ট্রেন ও উড়োজাহাজের কাউন্টারে সরাসরি দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হতো। এখন ঘরে বসে, অফিসে যেতে যেতে সহজেই বাস, লঞ্চ, ট্রেন, উড়োজাহাজের টিকিট কেনার সুযোগ নেওয়া যায়। পোশাক হল, বাড়ি যাবার টিকিটও হল। এখন দরকার আনন্দ—বিনোদনের অনুষঙ্গ। সিনেমা, নাটক দেখতে চাই। সিনেমা হলে না গেলেও চলবে। মোবাইল ফোনেও সব আছে। নাটক আছে, সিনেমা আছে। কাজেই কে চায় কষ্ট করে সিনেমা হলে যেতে? ঈদের বাজার দরকার। ঘরের বাইরে না গেলেও চলবে। অর্ডার করুন অনলাইনে। কাঙ্খিত সব কিছুই বাসায় হাজির হবে। আর এত সুযোগ সুবিধাই বদলে দিয়েছে ঈদের বর্তমান কালকে। তবে ঈদে বাড়ি ফেরার সেই ঝক্কি ঝামেলা শেষ হয়নি। ট্রেনে বাসে, লঞ্চে এমনকি উড়োজাহাজেও ভীড় আছে আগের মতোই। তবে বাড়ি ফিরে এখন আর সবাই পাড়া প্রতিবেশির খোঁজ নেয় না আগের মতো।মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকে সবাই। মোবাইল ফোনই যেন একমাত্র আনন্দের দুনিয়া। মোবাইলে খাই, মোবাইলেই দেখি, মোবাইলেই ঘুমাই এমন অবস্থা।

অতীতকালে ঈদ উৎসবে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরিবারের নানা বিষয় নিয়েই সকলে আনন্দে মেতে থাকত। এখন সেটা হয় না। যানজট, পথের ক্লান্তি ভেঙ্গে বাড়ি গিয়ে অধিকাংশ মানুষ মোবাইলেই ব্যস্ত সময় কাটায়। ফলে ঈদ উৎসবে কার্যত পরিবর্তন ঘটেছে। উৎসব হয় ঠিকই। সেখানে যেন প্রাণের অস্তিত্ব থাকে না। নিজের আনন্দ ছাড়া অন্যের আনন্দ গুরুত্ব পায় না। অথচ ঈদ মানেই মিলে মিশে থাকার আনন্দ উৎসব। ঈদ মানেই প্রিয়জনের মুখে হাসি আর আনন্দ। আসুন না এবার সেই পরিবেশটাই সৃষ্টি করি। প্রিয় পাঠক, পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা নিন। ঈদ মোবারক।

রেজানুর রহমান

Scroll to Top