আশ্রয়ণ প্রকল্প
অতি নিম্ন-আয়ের অবহেলিত মানুষের নানা লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হওয়া জীবনে আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে, কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ‘একটি ঘর’; যা ফুটে উঠেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের চোখে-মুখে!
এরা সবাই ‘মুজিব বর্ষ’-এর উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে পাওয়া কক্সবাজার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা। তেমনই একজন কামাল হোসেন।
আগে অন্যের জমিতে ফরমায়েশ খাটার বিনিময়ে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও এখন তিনি নিজেই একটি ঘরের মালিক। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নে টিঅ্যান্ডটি হাজেম রাস্তা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৮৮টি ঘরের একটি ঘর এখন তার।
২০২২ সালে এই ঘরটি জমিসহ বরাদ্দ পান কামাল হোসেন। ঘর নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই আত্মমর্যাদা ও কৃতজ্ঞতার অভূতপূর্ব এক ছবি ফুটে উঠলো, তার চোখে-মুখে। তার এই আত্মমর্যাদার কৃতজ্ঞতা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি!
কামাল হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নিজের জায়গায়, নিজের ঘর হবে, কোনোদিন এটা কল্পনাও করিনি কখনো। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারে আজ আমি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভালো আছি! প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো! আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন’!
সোমবার (১০ জুন) সরেজমিন এই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে সুবিধাভোগীদের একজন রাজ্জাক জোয়ার্দার বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নিজের জায়গা-জমি কিছু নেই! আগে মানুষের জায়গায় থাকতাম! বিনিময়ে কাজ করে দিতাম। তারপরেও নানা কটু কথা শুনতে হতো। তবে এই ঘর পেয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভালো আছি। এখন ফেরি করে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করি! বাদাম বিক্রি করি! সবসহ পাঁচ সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে ভালোই দিন কাটছে’।
একই আশ্রয়ণ কেন্দ্রের আরেক বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, ‘স্বামী নুরুল কবির যা আয় করতেন, তা দিয়ে তা বাসা ভাড়া দিয়ে কষ্ট খুব কষ্ট হতো। কোনোরকমে কষ্ট করে খেতে পারলেও কোনো আয় ছিল না। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াও করাতে পারতাম না। খুবই কষ্টে যাচ্ছিল জীবন’!
তবে এখন সময় পাল্টেছে রহিমা বেগমের। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে টাকাও জমাচ্ছেন তিনি। এসবই সম্ভব হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ঘর পেয়ে।
রহিমা বেগম বলেন, ‘এখন আর বাসা ভাড়া দেওয়া লাগতেছে না। নিজের ঘর হইছে! আমার স্বামী যা আয় করেন, তা দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু কিছু টাকাও জমাচ্ছি’!
ঝালমুড়ি বিক্রেতা স্বামীকে নিয়ে আগে উখিয়া সিকদারের বিল বড়বাজারে ভাড়া বাসায় থাকতেন গুলতাজ বেগম। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার হিসেবে ঘর পেয়ে এখন এসে উঠেছেন এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে। তার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে রবিউল হাসান (১২) ক্লাস সিক্সে পড়ে। মেয়ে জান্নাতুল বাকেয়া (৮) ক্লাস টুতে পড়ে আর মোহাম্মদ হাসানের বয়স তিন বছর।
গুলতাজ বেগম বলেন, ‘নিজেরা বাড়ি করবো, এমনটা কখনো ভাবিনি। তখন থাকা-খাওয়া নিয়েই কষ্ট হতো! বাড়ি করবো কী করে! এখন ছেলে লেখাপড়া করছে; স্কুলে যায়। আগের থেকে আয় রোজগার বেড়েছে। লেখাপড়া শিখে ছেলে-মেয়ে অনেক বড় হবে, সেই স্বপ্নটাই দেখি এখন’!
প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প স্বপ্ন দেখাচ্ছে গৃহহীনদের
কামাল, জোয়ার্দার, রহিমা ও গুলতাজ বেগমদের মতো সারাদেশে আরো প্রায় ২ লাখ ৬৬ হাজার ১২ জন ভূমিহীন মানুষকে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে জমিসহ গৃহনির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলার ৯টি উপজেলায় কয়েক ধাপে ৪ হাজার ৯শ ২৫টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে, যার সর্বশেষ ধাপে ২শ ৬১টি গৃহ হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে জেলাটিকে ‘গৃহহীনমুক্ত জেলা’ হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার।
শুধু জমি আর গৃহ নয়, তাদের সার্বিক উন্নয়নেও নজর দিয়েছে সরকার। তারই অংশ হিসেবে পুরুষদের জন্য স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিকস, গাড়ির ড্রাইভিং, মোবাইল ফোন সার্ভিসিংসহ অনেক ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে।
এছাড়াও নারীদের হাস-মুরগি পালন, কৃষিকাজ, বিভিন্ন ধরনের সেলাইয়ের কাজ, বুটিকসের কাজসহ বিভিন্ন ধরনের আয়বৃদ্ধিমূলক কাজ শেখানো হচ্ছে সরকারিভাবে।
এনিয়ে উখিয়ার নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, এখানকার বাসিন্দাদের জন্য ডিপ টিউবওয়েল, স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং, কৃষি, পশুপালন প্রশিক্ষণসহ ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে তোলা হচ্ছে। আমরা এখানে ‘বঙ্গবন্ধু সমবায় সমিতি’ও গঠন করে দিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা এখানকার উপকারভোগীদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলছি।
তানভীর হোসেন আরো বলেন, এখানকার শিশুদের খেলাধুলার জন্য পাশেই শেখ রাসেল স্টেডিয়াম করার পরিকল্পনা রয়েছে। দোলনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্লাব করা হয়েছে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার জন্য। বসার জন্য সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ ও মন্দির করে দেওয়ার জন্যও বাজেট করা হয়েছে।
পাল্টে যাচ্ছে আশেপাশের জনজীবন
শুধু যারা বাড়ি ও জমি পেয়েছেন তারাই নয় বরং এই প্রকল্পের মাধ্যমে এর আশেপাশের জনজীবনেও এসেছে পরিবর্তন। এখানে এতগুলো পরিবারের আশ্রয় হওয়ায় ফলে বিভিন্ন দোকান ও পণ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন আশেপাশের স্থায়ী বাসিন্দারাও।
তেমনই একজন মেহেরা খাতুন। মধ্যবয়েসি এই নারী ঘরের কাজের বাইরে কখনো কিছু করেননি। তবে তার বাড়ির পাশেই এই আশ্রয়ণ প্রকল্প হওয়ায় দিয়েছেন মুদি দোকান। বাড়ির কাজের পাশাপাশি দোকানেও বসেও বাড়তি আয় করছেন তিনি। পরিবারের এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা।
মেহেরা খাতুন বলেন, আগে ঘরের কাজ করতাম। এখন এই প্রকল্প হওয়ার পর দোকান দিয়েছি। এই দোকান থেকে ভালো আয় হয়। এই প্রকল্পের কারণে আমাদের উপকার হয়েছে। দোকানদারি করতে পারছি! বেচাকেনা হয়। এটা সবার জন্যই ভালো হয়েছে!
মেহের খাতুনের স্বামী সৈয়দ আলম দিনমজুর। এই দম্পতির চার মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ছে। এখন ভাড়ায় গাড়ি চালায়। বড় মেয়ে তানিসা আক্তারও ক্লাস ফাইভে পড়ে। স্কুল থেকে এসে বসে মায়ের দোকানে। এখন তার চোখেও বড় স্বপ্ন! স্বপ্ন তার ডাক্তার হওয়া!
তানিসা বলেন, ‘বড় হয়ে ডাক্তার হবো। ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। আগে এতে মানুষ না আছিল। এখন ভালা হয়ি। সাতটা বাজে দোকান খুলি। রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে’!