যাত্রীদের মারধরের শিকারে বাসের চালক ও সহকারী নিহত

যাত্রীদের মারধরের শিকারে বাসের চালক ও সহকারী নিহত

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার হাসেম মিয়া পেশায় ময়লা শ্রমিক। দিনভর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া ঘুরে ঘুরে বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করেন। হাসেম মিয়ার মতো ময়লা শ্রমিকের কারণে অট্টালিকার বাসিন্দারা পান দুর্গন্ধমুক্ত এক স্বস্তির জীবন। কিন্তু হাসেম মিয়ার জীবনে সামান্য স্বস্তি। চার সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকা আজিজখান রোডের একটি ছোট্ট খুপরি ঘরে হাসেম মিয়ার বসবাস। স্ত্রী জয়তন বেগমও গৃহ পরিচারিকার কাজ করে পরিবারের জন্য দুমুঠো খাবার যোগাতে ব্যস্ত। চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আলী মিয়ার বয়স ১৭ ও ছোট ছেলে হযরত মিয়ার বয়স ১৪ বছর। হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে টিকে থাকার লড়াই করে হাসেম কিংবা জয়তন সন্তানদের দিকে নজর দিতে পারেন না! ফলে যা হবার তাই হয়েছে! বিপথে পা বাড়িয়েছে দুই সন্তান। তাদের জীবনে বিপত্তি হয়ে ওঠে কিশোর বয়সী দুই ছেলের মাদকাসক্তি। সঙ্গদোষে কিশোর দুই ছেলের মাদকাসক্তি ভাবিয়ে তোলে হাসেম ও জয়তন দম্পতিকে। দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমিক এই দম্পতি ছেলেদের মাদক থেকে ফেরাতে পাঠান মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। সুস্থ হয়ে সঠিক পথে ফিরবে এই আশায় আয়ের সবটাই সন্তানদের পেছনে ঢালছিলেন তারা। এমন কি কিশোরী মেয়েকেও কাজে পাঠিয়েছেন, যদি ছেলেরা মাদক থেকে ফেরে সেই আশায়।

মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লোকজনও আশ্বাস দিয়েছিলো ময়লা শ্রমিক হাসেমের দুই ছেলেকে সুস্থ করে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেলো। বরং কথিত নিরাময় কেন্দ্র নামের বন্দিশালায় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে বসে বলে অভিযোগ হাসেম মিয়ার ছোট ছেলে হযরত আলীর বিরুদ্ধে। ফলে কেন্দ্র থেকে এখন জেলে কাটছে এই কিশোরের জীবন।আরেক ছেলে আলীও বন্দি। তাকে আটকে রাখা হয়েছে সেই নিরাময় কেন্দ্রে। তার কাছে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে ৪০ হাজার টাকা। সামান্য আয়ে জীবন চালানো হাসেমের কাছে এই টাকার যোগান দেওয়া অসম্ভব। জানেন না কিভাবে ছেলেকে মুক্ত করবেন।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসেম মিয়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে বাসায় ফিরে কেবল গোসল করেছেন। তখনও ফেরেননি স্ত্রী জয়তন। বেড়িয়েছেন সকাল ৭টায়। এক কক্ষের বাসাটিতে একটি খাট, একটি পুরাতন ফ্রিজ। আটোসাঁটো রুমটিতে নেই কোনো সিলিং ফ্যান। ছোট একটি টেবিল ফ্যানে শরীর ঠান্ডা করার চেষ্টা।

দুই ছেলের বিষয়টি তুলতেই চোখজোড়া যেনো ছলছল করে উঠলো হাসেম মিয়ার। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, “আমার ‍দুই ছেলেকে ভালো করোনের লাইগা দিছি। হ্যারা (তারা) কোইলো আপনার দুই ছেলেকে রাহেন (রাখেন), অমরা মানুষ কোইরে ছাইড়া দিমু। এই কথা বলেছিলেন সেন্টারের মালিক ফারহাদ।

সন্তানের কতটা ভালো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভালো তো করেই নাই এখন মার্ডার মামলার আসামি বানিয়েছে। কিভাবে মার্ডার হয়েছে সেটাও আমাদের ভালোভাবে জানায়নি। এমন কি ঘটনার তিনদিন পর পুলিশ আমাদের জানিয়েছে।”

কথা যখন চলছিলো তারই মধ্যে ঘরে ফেরেন হাসেমের স্ত্রী জয়তন। তিনি বলেন, “আমার দুই ছেলেকে কেন্দ্রে নির্যাতন করা হত। ছেলেরা মারধরের কথা আমাদের বলেছে কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি হয়তো তারা কেন্দ্রে (নিরাময় কেন্দ্র) থাকতে চায় না বলে নির্যাতনের কথা বলছে। পরে শুনলাম কিছু হলেই হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে।”

যেই ছেলেটা কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি মারধর করত সেই ছেলেকে নাকি হযরত চাকু দিয়ে মেরে ফেলেছে। এটা আমরা ঘটনার তিনদিন পর পুলিশের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বলেন হাসেম।

এক ছেলে কারাগারে আরেক ছেলে কেন্দ্রে উল্লেখ করে জয়তন বলেন, ছেলেদের দিলাম ভালোর জন্য এখন সব এলোমেলো হয়ে গেলো। এক ছেলেকে জেলে পাঠিয়েছে। আরেক ছেলেকে কেন্দ্রে আটকে রেখেছে। তার সঙ্গে কি হচ্ছে আমরা কিছুই জানতে পারছি না। বারবার যাওয়ার পরেও দেখা করতে দিচ্ছে না। তারা (নিরাময় কেন্দ্রের মালিক ও তার স্ত্রী) ফোন দিয়ে টাকা চায়। এমন কি বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গেছে টাকা না দিলে আমার বড় ছেলে আলীকেও মামলা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিবে।

এই ঘটনার বিষয়ে একটু খোঁজ নিতেই জানা গেলো ঢাকার অদূরে কেরাণীগঞ্জ থানার শ্যামলাপুর ঘাটারচরে ‘আমাদের প্রত্যাশা’য় কথিত মাদক নিরাময় কেন্দ্রের আড়ালে এক বন্দীশালার কথা। আর সেখানে নির্যাতনের ভয়াবহতা। এর আগে এই নিরাময় কেন্দ্রে যাওয়া দুই ভুক্তভোগীকে খুঁজে বের করে বার্তা২৪.কম। তাদের মধ্যে একজনের বয়স ১৭ বছর ও অন্যজনের ২৩ বছর। দুজনের কেউই তখন আর মাদকাসক্ত নয়। এরপরও পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে তাদের কেন্দ্রে ভর্তি রাখা হয়েছিলো।

১৭ বছর বয়সী কিশোর রায়হান (ছদ্মনাম) বলেন, আমি দুই মাস ছিলাম। কোনো ত্রুটি পেলেই মারধর করত নানাভাবে শাস্তি দিতো। সবচেয়ে বেশি মারধর করত সোমেন দাদা (সোমেন দাস)।

হযরত ও তাকে একই রশিতে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে উল্লেখ করে রায়হান বলেন, একদিন ছোট একটা ভুলের কারণে হযরত ও আমাকে একই রশিতে বেধে সোমেন আমাদের নির্যাতন করেন। পান থেকে চুন খসলেই সোমেন রেগে গিয়ে মারধর করত। একদিন রুটি বানাতে দিয়েছে, রুটির সংখ্যা কম হওয়ায় আমাকে ও অন্য একটি ছেলেকে এক সঙ্গে মারধর করেছে। কয়েকজন মিলে হাত-পা ধরে রাখত আর বেত দিয়ে কেন্দ্রের মালিক ফারহাদ মারত। রুটি বানাতে গিয়ে আমার হাত পুড়ে গেছিলো। সেই দাগ এখনো আমার হাতে আছে, বলেন রায়হান।

নির্যাতনের বাইরেও কেন্দ্রে রয়েছে থেরাপি নামের মানসিক নির্যাতন। ছোটখাটো ভুলে থেরাপি (শাস্তি) চাল ডাল দিয়ে আলাদা করার জন্য সারাদিন বসিয়ে দেওয়া হতো। চোখে কাঠের চশমা দিয়ে, হাতে তবজি দিয়ে বসিয়ে রাখা হত দীর্ঘ সময়।

২৩ বছর বয়সী তরুণ শাওন (ছদ্মনাম)। বার্তা২৪.কমকে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বলেন, আমি ওই সেন্টারে ছয় মাস ছিলাম। সেখানে প্রচুর পরিমাণ নির্যাতন করা হত। নির্যাতনের কথা পরিবারকে বলতে পারতাম না। ভয় দেখানো হতো, নির্যাতনের কথা পরিবারকে বলে দিলে আটকে রাখার হবে।

শাওন আরও বলেন, আমি মাদকাসক্তির কারণে যাই নি। পরিবার পাঠিয়েছে আমার রাগ বেশি এ জন্য। আমাকে ইসলামের পথে আনার জন্য পাঠানো হয়। অথচ সেন্টারে যাওয়ার পর আমি মাদক সম্পর্কে সব জেনে গেছি। কোন মাদক খেলে কি হয়, কোথায় কি ভাবে কিনতে পাওয়া যায়। সেন্টারে সকাল থেকে একের পর এক ক্লাস করানো হতো। যেখানে মাদক সম্পর্কেই নানা আলোচনা করা হত। সেখানে ধর্ম সম্পর্কে কোনো আলোচনা হত না। মনগড়া সব গল্প বলা হতো। ক্লাস জুড়ে নেশার গল্প বলা হতো। সবচেয়ে বড় বিষয় সেখানে প্রতিটি মুহুর্তে মানসিক নির্যাতন করা হত। আর এর প্রতিবাদ করলেই নানা ধরনের থেরাপি (শাস্তি) দেওয়া হত। গ্রিলের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হত, নারীদের পোশাক পড়ানো হত, ছেড়া পোশাক পড়ানো হত, জিপ্সি (কার্টুন) বানিয়ে রাখত।

কিশোর হযরতের হাতে কর্মী নিহতের বিষয়, সুস্থ শিশু-কিশোরদের নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি রাখা এবং নির্যাতনের বিষয়ে জানতে ‘আমাদের প্রত্যাশা’ মাদক নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক ফারহাদ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

এই প্রতিবেদকরে পরিচয়ে পেয়ে তিনি জানান সড়ক দূর্ঘটনায় পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন। কথা বলতে পারবেন না। এই প্রতিবেদকের সঙ্গ পরবর্তীতে যোগাযোগ করবেন। পরের দিন আবারও যোগাযোগ করা হলে তার মেয়ে লিজা জানান তার বাবা অসুস্থ। পরে যোগাযোগ করবেন।

নিরাময় কেন্দ্রে কিশোর বন্দির হাতে তরুণ নিহতের বিষয়ে জানতে চাইলে লিজা বলেন, বিষয়টা আমার জানা আছে। ঘটনার পরপর আমরা ঘটানস্থল পরিদর্শন করেছি।

প্রত্যাশা নিরাময় কেন্দ্রে নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এমন কোনো ঘটনা আমাদের জানা নেই। কেউ যদি অভিযোগ করে আমরা ব্যবস্থা নেবো।

মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সুস্থ কিশোরদের রেখে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা জেলার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো বাহাউদ্দিন বলেন, কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে মাদকাসক্ত বক্তির সংস্পর্শে রাখার সুযোগ নেই। মাদক নিয়েরাময় কেন্দ্রে রাখার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে ডোপ টেস্ট করাতে হবে। আর এটা তো ব্যক্তি মালিকানাধীন তাই খরচের একটি বিষয় আছে। তাই মাদক গ্রহণ করে না এমন কেউকে রাখার সুযোগ নেই।

এদিকে সোমেন দাস হত্যার ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার আটিবাজার পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমরান হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও মরদেহ উদ্ধার করেছেন। মামলার তদন্তও করছেন ইমরান। তিনি বলেন, সোমেন দাসের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ২০ বছর বয়সী হযরতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনায় নিহতের পরিবার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। হত্যার কারণ জানতে তদন্ত চলছে।

হত্যা বিষয়ে গ্রেফতার হযরতের পরিবারকে ঘটনার তিনদিন পর জানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই ইমরান বলেন, আমরা জানাইনি। প্রত্যাশা থেকেই জানানো হয়েছে। তবে তারা প্রথমে বিষয়টি বিশ্বাস করেন নি। তাদের বিশ্বাস করাতে ৬ ঘন্টা লেগেছে।

“অশিক্ষিত একটি পরিবার। তারা কোনো ভাবেই ঘটনা বিশ্বাস করেন নি। পরবর্তীতে একজনের মাধ্যমে ভিডিও কলে ছেলেকে দেখানো ও ছবি পাঠানো হয়। নিরাময় কেন্দ্রের পাশাপাশি আমরাও জানিয়েছি,” বলেন ইমরান।

এ দিকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত হযরতের পরিবারের দাবি তার বয়স ১৪ বছর। অথচ ১৪ বছরের শিশুকে ২০ বয়সী দেখিয়ে মামলা নিয়েছে পুলিশ। যা রহস্যজনক!

এই ঘটনায় গ্রেফতার হযরত বর্তমানে কেরাণীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে। অভিযুক্ত হযরতের বয়স প্রমাণে পরিবারটি ভাসমান হওয়ায় জন্মনিবন্ধন ও টিকা কার্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পাওয়া যায় নি।

নিহত সোমেন দাসের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার শ্রীরামকাঠি। সেখানকার সুকুমার দাসের একমাত্র ছেলে সোমেন। সুকুমার দাস পেশায় কৃষক।

Scroll to Top