একাত্তরের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রে একাত্তর

একাত্তরের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রে একাত্তর

ফিচার ডেস্ক

বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ। হানাদার পাকিস্তানিদের সঙ্গে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই জাতি পেয়েছে পরম আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে নির্মিত হয়েছে কালোত্তীর্ণ বেশ কিছু সিনেমা। এই সিনেমাগুলো আমাদের অহংকারের মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণ মানুষের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পালন করেছে বেশ শক্তিশালী ভূমিকা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চারটি চলচ্চিত্র। ছবিগুলো হচ্ছে চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’, সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দের ‘বাঘা বাঙ্গালী’।একাত্তরের ছবি, ছবিতে একাত্তর।

এরপর ৪৬ বছরে নির্মিত হয়েছে প্রায় দেড় ডজন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিনেমা হলো আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩), চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪), আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ (১৯৭৪), হারুণর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ (১৯৭৬), শহীদুল হক খানের ‘কলমী লতা’ (১৯৮১), নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘৭১-এর যীশু’ (১৯৯৩), হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪), তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫), তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘নদীর নাম মধুমতী’ (১৯৯৫), চাষী নজরুল ইসলামের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৯৭), হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৫), তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ (২০০৮), চাষী নজরুলের ‘ধ্রুবতারা’ (২০০৯) এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘গেরিলা’ (২০১১)।

‘ওরা ১১ জন’ স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্র বাঙালির মরণপণ মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের ১৩ আগস্ট মুক্তি পাওয়া ছবিতে অভিনয়ও করেন ১১জন মুক্তিযোদ্ধা। সেসময় তাদের কেউই পেশাদার অভিনেতা ছিলেন না। এরা হলেন, খসরু, মঞ্জু, হেলাল, ওলীন, আবু, আতা, নান্টু, বেবী, আলতাফ, মুরাদ ও ফিরোজ। ১১ দফার ছাত্র আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে মাথায় রেখে প্রতীকী অর্থে এ চলচ্চিত্রের নামকরণ করা হয় ‘ওরা ১১ জন’। চলচ্চিত্রের শুরুতে টাইটেলে ছয়টি কামানের গোলার শব্দ শোনা যায়। পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের মতে, এ ছয়টি শব্দ হচ্ছে ছয়দফা দাবির প্রতীকী শব্দ। এই চলচ্চিত্রে যে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ব্যবহার হয়েছিল সবই ছিল সত্যিকারের। ‘ওরা ১১ জন’ সেসময় মস্কো, ইংল্যান্ড, জামশেদপুর, রাচী, কলকাতা ও বোম্বেতে প্রদর্শিত হয়েছিল।

এরপর মুক্তি পেয়েছিল সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ চলচ্চিত্রটি। তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বিষয়বস্তুগত দিক দিয়ে এ চলচ্চিত্রটিকে একেবারেই অন্যরকম। এ চলচ্চিত্রের ঘটনা মূলত এক চিত্র অভিনেতার মুক্তিযুদ্ধকালের অভিজ্ঞতাকে ঘিরেই। যিনি যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে রক্ষা পেতে ভারতে পালিয়ে যান এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিবেকের দংশনে দংশিত হতে থাকেন। ছবিটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আনোয়ার হোসেন, এছাড়াও বীরাঙ্গনার চরিত্রে অভিনয় করেন চিত্রনায়িকা ববিতা।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার মধ্যে ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমাটি অন্যতম। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিজের লেখা উপন্যাস থেকে নির্মাণ করেন ছবিটি। যুদ্ধকালীন একটি পরিবারের দুঃখ, ভয় ও প্রাপ্তির স্বপ্নঘেরা গল্পের জীবন্ত চিত্রায়ন ছিলো এই চলচ্চিত্র। আবুল হায়াত, ডলি জহুর, বিপাশা হায়াত, আসাদুজ্জামান নূরের দুর্দান্ত অভিনয়ে ‘আগুনের পরশমণি’ ছবিটি ১৯৯৪ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। বিপাশা হায়াত পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর স্বীকৃতি।

রাজাকার বাবা ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের গল্প নদীর নাম মধুমতী। স্বাধীনতা বিরোধী বাবার সঙ্গে মুক্তিকামী সন্তানের কী করা উচিৎ, তাই ছবিতে দেখিয়েছেন নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল। ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি তিনটি বিভাগে জিতে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৯৭ সালে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করতে গিয়ে এক মা তার পুত্রকে তুলে দেন হানাদারদের হাতে। তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মা নিজের পুত্রের চেয়েও দেশকে বড় করে দেখেছিলেন। এমন মর্মস্পর্শী ত্যাগের গল্পের এই চলচ্চিত্রটি শুধু প্রশংসাই পায়নি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করে। এতে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা, সুচরিতাসহ অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন আমেরিকান সাংবাদিক লিয়ার লেভিন সেখানকার এক টেলিভিশন কোম্পানির জন্য মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীরা কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এর ওপর কিছু ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন। স্বাধীনতার ২২ বছর পর সেই ছবি উদ্ধার করেন তরুণ চলচ্চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ। সেখান থেকে ছবি বাছাই করে নির্মাণ করেন একটি চমৎকার চলচ্চিত্র। সিনেমার শিরোনাম দেন ‘মুক্তির গান’। এটি ১৯৯৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পায় জাতীয় পুরস্কার। ১৯৭৯ সালে হারুনর রশীদ নির্মাণ করেন ‘মেঘের অনেক রং’ ছবিটি। এ চলচ্চিত্রের পুরো কাহিনী উঠে এসেছে একটি শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে। সদ্যবোধসম্পন্ন যে ছেলেটি তার মাকে খুঁজে বেড়ায়। এরই ফাঁকে চলে আসে যুদ্ধের কথা। যুদ্ধে তার মা পাক বাহিনীর লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এতে অভিনয় করেন রওশন আরা, ওমর এলাহী মাথিন ও মাস্টার আদনান। এই ছবিটিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিজের লেখা উপন্যাস থেকে আরো একটি সিনেমা নির্মাণ করেন ২০০৫ সালে। ‘শ্যামল ছায়া’ নামের ওই ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধে এক তরুণীর আত্মত্যাগের ঘটনার বিশদ বর্ণনা উঠে আসে। সে বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই সিনেমায় অভিনয় করেন হুমায়ুন ফরীদি, চ্যালেঞ্জার, রিয়াজ, শাওন, ডা. এজাজ।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্রকার নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ২০১১ সালে নির্মাণ করেন ‘গেরিলা’। যুদ্ধকালীন পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের ঘৃণিত তৎপরতা ও বর্বরতা এ চলচ্চিত্রে মর্মস্পর্শীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। পাক সেনা কর্মকর্তার পৈশাচিকতার বিস্তারিত বর্ণনাও পাওয়া যায় এই ছবিতে। ২০১১ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, পরিচালকসহ দশটি ক্যাটাগরিতে এই চলচ্চিত্র পায় জাতীয় পুরস্কার। এতে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, শতাব্দী ওয়াদুদসহ আরও অনেকে।

কেবল সিনেমাই নয়, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক প্রামাণ্যচিত্রও মুক্তিযুদ্ধকে অসামান্যভাবে তুলে ধরেছে সাধারণ মানুষের কাছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়েই চলচ্চিত্র নির্মাতারা যুদ্ধের কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। জহির রায়হান নির্মাণ করেন অনন্য ছবি ‘স্টপ জেনোসাইড’, যা বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অন্য চলচ্চিত্রগুলো হলো—আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, শুকদেবের ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ ও বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Scroll to Top