ইফতারেও ঐতিহ্যের মেজবান

ইফতারেও ঐতিহ্যের মেজবান

পোস্তদানা, মিষ্টি জিরা, নারকেল, বাদামবাটা। সঙ্গে আরও কয়েক পদের মসলা। তারপর গরুর মাংস মেখে বড় ডেকচিতে ভরে সরিষার তেলে রান্না। মূল পদ গরুর হলেও অবশ্য রান্নার ধরন একেবারেই আলাদা। রান্নার ডেকচি থেকে চুলা, আগুনের আঁচ-সবকিছুই নিয়মমাফিক। বিশেষভাবে তৈরি এই রান্নাই হলো-‘মেজবানি মাংস।’ সেই মাংসের সঙ্গে ভাত, নলার ঝোল, মাংসের ছাঁটছুট আর ডাল দিয়ে লাউয়ের তরকারি মাটির শানকিতে ভরে খাওয়া-আহ কী স্বাদ!

চট্টগ্রামের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের চাহিদা এই অঞ্চলে থাকে সারা বছরই। বাইরে থেকে কেউ বন্দরনগরীতে এসেছেন, আর একবার হলেও মেজবানের স্বাদ নিতে চাননি-এমন কাউকে পাওয়া কঠিনই। সেই খাবার এখন ঢুকে পড়েছে ইফতারেও। দিনভর রোজা শেষে তৃপ্তিভরে খেতে তাই অনেকেই ঢুঁ মারেন মেজবানের মাংস আছে এমন রেস্তোরাঁ আর দোকানে। কেউবা আবার ঘরেও নিয়ে আসেন মেজবানের মাংস।

নগরের চৌমুহনী এলাকার পীরবাড়ি রোডের অস্থায়ী দোকানগুলোর মেজবানি মাংসের সুনাম আছে পুরো চট্টগ্রামেই। বিকেলে সেই রোডে ঢুকলেই এখন নাকে আসে মেজবানি মাংসের সুগন্ধ। রাস্তার দুই পাশেই সারি সারি মেজবানের মাংসের দোকান। সেখানে টেবিলে থরে থরে সাজানো ছোট-বড় বাটি। অন্য পাশে মেজবানের মাংসের বড় বড় ডেকচি। হালকা আঁচে মাংস গরম রাখার ব্যবস্থাও আছে। ক্রেতা এলেই হাঁড়ি থেকে গরম মাংস ভরা হয় বাটিতে। সঙ্গে চাইলে নিয়ে যেতে পারেন ছোলার ডালও। রমজানজুড়ে চলে মেজবানি মাংস বিক্রির এই ব্যস্ততা।

পীরবাড়ি রোডে মেজবানি মাংস বিক্রির শুরুটা যাদের হাত দিয়ে, তাদের মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদ মনজুর বাবুর্চি। তার বাবা আবদুল খায়ের ছিলেন চট্টগ্রামের এক সময়ের বিখ্যাত বাবুর্চি। বাবার কাছ থেকে মেজবানের মাংস রান্নার হাত পাকান মনজুর বাবুর্চি। এখন পুরো দেশেই মেজবানের মাংস রান্নার জন্য ডাক পড়ে তার।

মনজুর বাবুর্চি বলেন, ‘২০০৩ সালে ছোট্ট দোকানে মেজবানের মাংস বিক্রি শুরু করি। জনপ্রিয়তা বাড়লে ধীরে ধীরে বাড়ে দোকানের প্রসারও। দোকানের পেছনের জায়গায় সকালে রান্না করি মেজবানি মাংস। আর দুপুরের পর থেকে শুরু করি বিক্রি। এখন প্রতিদিন ৪০-৫০ কেজি মেজবানের মাংস বিক্রি হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকেও এখানে মেজবানের মাংস কিনতে ছুটে আসেন অনেকে।’

মনজুর বাবুর্চির কথার প্রমাণ মেলে একটু পরেই। প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরের চকবাজারের কাপাসগোলা থেকে পীরবাড়ি রোডে মাংস কিনতে এসেছিলেন জামাল উদ্দিন। মাংস কেনার ফাঁকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেজবানি মাংসের আসল যে স্বাদ, সেটি এখানকার দোকানগুলোতেই শুধু পাওয়া যায়। তাই দূরে হলেও কষ্ট করে চলে এলাম। ইফতারিতে খাব যেহেতু, ভালোটাই খাই।’

পীরবাড়ি রোডের একটি দোকানে মেজবানি মাংস বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিক্রেতা। ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল


২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে মেজবানি মাংস বিক্রি করাদের আরেকজন কুতুব উদ্দিন। তিনি তার আরেক ভাই মোহাম্মদ ইদরিছ ও স্থানীয় মাংস বিক্রেতা মোহাম্মদ ইলিয়াসকে নিয়ে শুরু করেন মেজবানি মাংস বিক্রি। এখন ইদরিছ আর ইলিয়াস দুজনেই মারা গেছেন। কুতুব তার নিজের ও চাচাতো ভাইসহ ১১ জনকে নিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন পুরনো ব্যবসাটি।

কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রামের বিখ্যাত আবদুল খালেক বাবুর্চি এই মেজবানি মাংস রান্না করেন। রোজার প্রথমদিকে প্রতিদিন ১৫-২০ কেজি মেজবানি মাংস বিক্রি হয়। তবে তা ধীরে ধীরে ৫৫-৬০ কেজি পর্যন্ত চলে যায়।’

আব্দুল খালেক বাবুর্চি ২২ বছর ধরে এখানে মেজবানি মাংস রান্না করছেন। সুপরিচিত এই বাবুর্চি বলেন, ‘আগে নানা অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেজবানি মাংস খেত মানুষ। তবে কয়েক বছর ধরে ইফতারেও মানুষ মেজবানি মাংসের স্বাদ নিচ্ছে। চাহিদা তাই আগের চেয়ে বেড়েছে।’

আগে শুধু পীরবাড়ি রোডকেন্দ্রিক মেজবানি মাংসের অস্থায়ী দোকানগুলো থাকলেও এখন নগরের পাঠানটুলী, শেখ মুজিব রোড, বাদামতলী এলাকা পর্যন্ত দোকান দেখা যায়। গত কয়েক বছরে অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোতেও ঢুকে পড়েছে মেজবানির পদ। এখন ইফতারির বিশেষ পদ হিসেবে মেজবানি মাংস বিক্রি করছে। বারকোড রেস্টুরেন্ট গ্রুপ একাই ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ন’ নামে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মেজবানের মাংস বিক্রির কয়েকটি রেস্তোরাঁ খুলেছে। ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে আছে ‘মেজ্জাইন্নাবাড়ি’ নামের আরও একটি মেজবানি মাংসের রেস্তোরাঁ।

এখন বন্ধুদের দলকে প্রায় সময় এসব রেস্তোরাঁয় ইফতারের সময় মেজবানি মাংস খেতে ভিড় করতে দেখা যায়। মুরাদপুরের ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ন’-এ ইফতার করতে এসেছিল বন্ধুদের একটি দল। সেই দলের একজন শামসুল ইসলাম চৌধুরী বললেন ‘মেজবানি মাংসের আসল স্বাদ বাসার রান্নায় মেলে না। কেননা এটা রান্না করতে হয় বড় ডেকচিতে। সেজন্য বন্ধুদের নিয়ে ইফতারে মেজবানি মাংস খেতে রেস্তোরাঁয় চলে আসি মাঝে মাঝে।’

বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও অস্থায়ী দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গরুর মাংসের দাম ক্রমেই বেড়ে চলায় মেজবানি মাংসও বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে। রেস্তোরাঁ ও দোকানভেদে প্রতি কেজি মেজবানি মাংস ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ডাল বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। আবার চাইলে জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়ও নিতে পারছেন মেজবানি মাংস, ভাত ও ডালের প্যাকেজ।

অবশ্য স্বাদে-গুণে মেজবানি মাংস এমনই এক জিভে জল এনে দেওয়া পদ, দামে কি বা আসে যায় ভোজনরসিকদের!

Scroll to Top