রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত

রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত

রায়হান উদ্দিন

ইসলামি বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে রমজান মাস হলো নবম মাস। যেই মাসে বিশ্বব্যাপী মুসলমান নর- নারীরা রোজা পালন করে থাকে এবং ইবাদতে মশগুল থাকে। রমজান মাসে রোজা পালন ইসলামী পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়তম। এ রমজান মাসে ৩ ভাগ রয়েছে। প্রথম ১০ দিন রহমতের মাস। দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাতের মাস। তৃতীয় এবং শেষ ১০ দিন নাজাতের মাস। এ পবিত্র মাসে মুসলমান নর- নারীরা মহান রবের দয়া ও বরকত প্রাপ্তির যোগ্য করে তোলে।

রোযা শব্দটি ফার্সি শব্দ। যার অর্থ হলো- উপবাস করা। আর সওম মানেই রোযা। সাওম আরবী শব্দ। যার অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা ও সরল সোজা হওয়া। সুবহি সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোযা বলা হয়। [আল মুখতাসারুল কুদরী ও তাফসীরে নঈমী]

মহান আল্লাহতায়ালা; ঘোষণার মাধ্যমে হিজরতের দেড় বছর পর অর্থাৎ হিজরি সনের দ্বিতীয় হিজরীতে রমজানের পূর্বের মাস শাবান মাসের ১০ তারিখে উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর পবিত্র রমজান মাসের রোজা ফরজ করেছেন। সকল সুস্হ, প্রাপ্ত বয়স্ক, জ্ঞানবান মুসলিম নর- নারীর উপর এ পবিত্র রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। পার্থিব লোভ- লালসা, হিংসা বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে তাকওয়া হাসিলে রমজানের রোজার গুরুত্ব ও অবদান অপরিসীম। [দূররে মুখতার, খাযাইনুল ইরফান ও খাযিন]

ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদ ফোক্বাহায়ে কেরাম ফিকহ শাস্ত্রের কিতাবগুলোতে রোজার প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন। তারা ফিক্বহশাস্ত্রের কিতাবসমূহে রোজাকে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করেছেন। ফরয রোজা ও নফল রোজা। [মুখতাসারুল কুদুরী]

নামায, সিজদা ইত্যাদি ইবাদত ফিরশতা, জ্বিনসহ অন্যান্য মাখলুকাত সম্পন্ন করে থাকে। কিন্তু রোজা একমাত্র মানবজাতির জন্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ইবাদত। যা অন্যদের দেওয়া হয়নি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা বান্দানীরা এ পবিত্র রমজান মাসে সারাদিন ব্যাপি অনাহারে থেকে আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। এ রমজান মাসে রাতে তারাবীহ নামায আদায় করে থাকেন মুসলিম নর- নারীরা এবং বেশিরভাগ মসজিদে তারাবীহ নামাযে পবিত্র কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করে কোরআন খতম দিয়ে থাকেন। এ পবিত্র মাসে সিয়াম পালনের দ্বারা আল্লাহর দিদার লাভে যোগ্য বলে গণ্য হয়। ইখলাস একনিষ্ঠতার সাথে ঈমানদাররা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে। অনেকেই পবিত্র রমজান মাসে ইতিকাফের নিয়ত করে থাকে। কেউ কেউ রমজানের শেষের ১০ দিন ইতিকাফ করেন। এ মাসে রয়েছে শবে ক্বদর। এ পবিত্র মাস কোরআন নাজিলের মাস। এ মাসে শবে ক্বদরের রাত্রে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর পবিত্র কোরআন নাজিল হয়।

রমজানের রোজার ফজিলত

রোজার ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপরও ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা খোদাভীরু তথা তাকওয়াবান হতে পারো। [সূরা বাক্বারাহ, আয়াত ১৮৩]

শান্তি, অফুরন্ত রহমত, বরকত ও ফজিলতে পরিপূর্ণ এই রমজান মাস। এ রমজান মাসের রোজা রাখার ফজিলত অনেক। পবিত্র কোরআনের সূরা বাক্বারার অন্য আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন- তোমাদের মধ্যে যেই রমজান মাসে উপস্থিত থাকে, অর্থাৎ যে রমজান মাস পায়, তাকেই রোজা পালন করা আবশ্যক। কারণ এতে অশেষ কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিহিত রয়েছে। [সূরা বাক্বারাহ আয়াত:১৮৬]

পবিত্র রমজানের ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের পাশাপাশি বিভিন্ন হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে রমজানের রোজা রাখে, তার অতীত জীবনের যাবতীয় গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে রমজানে ইবাদত করে, তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। [এই হাদিসটি বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে।]

রমজানের রোজা পালন করার মাধ্যমে শয়তানী ধোঁকা ও কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পায়। তাই এ পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহর বান্দা বান্দানীরা মহান রবের ইবাদতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। ইবাদত করার মাধ্যমে খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা যায়। অন্য হাদিসে পাক এ এসেছে; হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যখন রমজান মাস আগমণ করে, আকাশের দরজা গুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের বন্দী করা হয়। অন্য এক বর্ণনা মতে, রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। [এই হাদিসটি বুখারি ও মুসলিম শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে] আরও একটি হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- এটি এমন মাস যার প্রথমাংশ রহমত বা দয়া, মধ্যম অংশ মাগফিরাত তথা ক্ষমা এবং শেষাংশ নাজাত বা দোজখ হতে মুক্তি দানের জন্য নির্ধারিত। এ মাস পাপ পরিহার করার এবং সৎকাজে নিজেকে নিয়োগ করার মাস। [বায়হাকি ও মিশকাত]

এ পবিত্র মাসের রোজা যুগ যুগ ধরে রোযা রাখার চেয়ে উত্তম। সারা বছর ব্যাপি রোজা রাখলেও পবিত্র রমজান মাসের একটি রোজার সমান হবেনা। রমজানের রোজার গুরুত্ব অনেক। হাদিস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে- হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কোন শরয়ী অনুমোদন ছাড়া বা কোন রোগ ব্যাধি ব্যতীত কোন ব্যক্তি যদি পবিত্র রমজান মাসের একটি রোজা ভেঙ্গে ফেলে, তাহলে এর কাজা হবে না যদিও সে যুগ যুগ ধরে রোজা রাখে। [মিশকাত] অন্যত্র মহান রাব্বুল আলামিন হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ করেন- রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। [বুখারী ও মুসলিম]

সাহরী ও ইফতারের ফজিলত:- হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- তোমরা সাহরী আহার করো। কেননা, সাহরী আহারের মধ্যে বরকত রয়েছে। [এই হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে]

অন্য একটি হাদিসে সাইয়্যেদুনা হযরত সালমান ইবনে আমের রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ইফতার করার ইচ্ছা করে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে। কেননা, খেজুর বরকতময়। আর যদি খেজুর না পায় তবে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কেননা পানি পবিত্র করে। [মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী শরীফ, আবূ দাউদ ও ইবনে মাজাহ শরীফ]

রমজানে করণীয়

১. পবিত্র রমজানে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা।
২. সময়মত ফরজ ইবাদত করা এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা।
৩. রোজা অবস্হায় খারাপ কথা, মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, গিবত, কারও অন্তরে কষ্ট না দেওয়া, জুলুম করা, নাচ ও গান না দেখা ইত্যাদি কুরআন- সুন্নাহ বিরোধী কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। এই গুলো দ্বারা সওয়াব কমে যায়।
৪. প্রতিবেশি ও আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর নেওয়া।
৫. ভোর রাতে সেহেরী খাওয়া। হাদীস শরীফে আছে তোমরা সেহেরী খাও এতে বরকত রয়েছে। [বুখারী ও মুসলিম]
৬. ইফতারের সময় ইফতার সামনে রেখে দোয়া দরুদ পড়া। হাদিসে আছে, ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়। [আবু দাউদ]
৭. রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা।

পবিত্র রমজানে মহান রাব্বুল আলামিন বেহেশতের দরজা খুলে দেন এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে রাখেন। শয়তানকে বন্দি করে রাখেন। কবরের আযাব দেন না এ পবিত্র মাসে। রমজান মাসে সওয়াল জওয়াব করা হয় না। রমজানুল মোবারকে মহান রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর কুরআনুল কারীম নাজিল করেন। এ পবিত্র মাস রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা অত্যধিক। এ পবিত্র মাসে ইবাদত বন্দেগি করে সবাই যেন কাটাতে পারে সে তওফিক দান করুক। আল্লাহ পাক আমাদের রমজান মাসের বরকত ও ফয়ুজাত দানে ধন্য করুক।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Scroll to Top