কম্পিউটারের প্রথম ভাইরাসের জন্ম পাকিস্তানে, আরও যা জানা গেল

কম্পিউটারের প্রথম ভাইরাসের জন্ম পাকিস্তানে, আরও যা জানা গেল

১৯৮৬ সালের এক ঘটনা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে লোকজনের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে হঠাৎ করেই ভয়াবহ একটি বাক্য ভেসে উঠেছিল: ‘ওয়েলকাম টু দ্য ডানজন’। এর অর্থ- ভূগর্ভস্থ অন্ধকারে আপনাকে স্বাগতম। মূলত, এই বার্তাটি ছিল একটি কম্পিউটার ভাইরাস। নাম ব্রেইন। ধারণা করা হয় এই ভাইরাসটি পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসির প্রথম ভাইরাস।

মঙ্গলবার ১২ মার্চ বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ‘ব্রেইন’ ভাইরাসের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের লাহোরের একটি দোকানে। কিন্তু ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। এর জন্মের সাথে জড়িত ছিল পাকিস্তানি দু’ভাই আমজাদ ফারুক আলভী ও বাসিত আলভী।

পরে তাদের কোম্পানি ব্রেইন কম্পিউটার সার্ভিসেসের নামানুসারে এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয়।

আমজাদ ফারুক আলভী জানান, তাদের তিন ভাই কম্পিউটারের ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। তিনি বলেন, শৈশবে বেড়ে ওঠার সময়েই তিনি কম্পিউটারের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। স্কুলে পড়ার সময়েই আমার পিতা আমাদেরকে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সদস্য করে দিয়েছিলেন। প্রায়শই আমি স্কুল ফাঁকি দিয়ে এই লাইব্রেরিতে চলে যেতাম। সেখানে ইলেকট্রনিক্স ও কম্পিউটারের ওপর যেসব বই ছিল তার সবই পড়ে ফেলেছিলাম।

স্কুল পালিয়ে এ ধরনের বই পড়ার ফল শেষ পর্যন্ত তার জন্য ভালোই হয়েছে। গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানে তিনি ডিগ্রি নিয়েছেন। পরে তিনি ও তার ভাই মিলে লাহোরের এক দোকানে তাদের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

কম্পিউটার দোকান ‘ব্রেইন’র শুরু
তারা ১৯৮৩ সালের দিকে এই ব্যবসা শুরু করেন। তাদের কাজ ছিল পাকিস্তানে ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের একটি ছোটখাটো কম্পিউটারের সার্ভিস দেওয়া। এই কম্পিউটারের নাম সিনক্লেয়ার। স্যার ক্লাইভ সিনক্লেয়ার এটি তৈরি করেছিলেন।

আমজাদ ফারুক আলভী বলেন, পাকিস্তানে ছোটখাটো এই হোম কম্পিউটারের আমরাই ছিলাম একমাত্র সার্ভিস প্রোভাইডার। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আইবিএম পিসি কম্পেটবলসের বিক্রি শুরু হয়ে গেল।

কম্পিউটার প্রস্তুতকারী কোম্পানি আইবিএম, যা আসলে ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ছিল। সেটি একসময় কম্পিউটার ব্যবসার প্রতিযোগিতায় সব জাপানি কোম্পানিকে পরাজিত করলো।

আমজাদ ও তার ভাই তখন এই আইবিএম কম্পিউটারের সার্ভিস দেওয়া এবং এই কম্পিউটার বিক্রি করতে শুরু করেন। এরপর দু’ভাই-এর ব্যবসার প্রসার ঘটতে লাগল। কিন্তু আমজাদ তখনও কম্পিউটার কোডিং নিয়ে খেলার নেশায় মত্ত ছিলেন। তিনি বলেন, সেসময় আমি দু’টা প্রোগ্রাম একসাথে কিভাবে চালাতে হয় এসংক্রান্ত একটি লেখা পড়লাম। একটি প্রোগ্রাম চলবে সামনে এবং পেছনে অন্য প্রোগ্রামটিও চলতে থাকবে।

যেভাবে ভাইরাসের জন্মের সূচনা
আমজাদ মনে করলেন এই প্রোগ্রামটি হয়তো মানুষকে বিস্মিত করতে পারে। তখন তিনি এরকম একটি প্রোগ্রাম তৈরির কথা চিন্তা করলেন। তিনি বলেন, আমার মনে হলো, কেউ একজন যদি দীর্ঘ সময় ধরে একটি প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করতে থাকে, তাহলে তার কাজে ব্রেকের জন্য, কিংবা তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে, পেছনে চলতে থাকা একটি প্রোগ্রাম হঠাৎ করেই সামনে চলে এসে তাকে গল্প বলতে পারে অথবা বই থেকে কিছু পাঠ করে শোনাতে পারে।

আমজাদ তখন এ ধরনের একটি প্রোগ্রাম তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। একসময় তার বন্ধুরা দেখল কম্পিউটারে কঠিন কঠিন সব কাজ করার সময় হঠাৎ করেই তাদের স্ক্রিনে ভিন্ন ধরনের স্টোরি ও কথা ভেসে উঠছে। এটা দেখে তারা সবাই অবাক হলো।

আমজাদ বলেন, ‘তখন আমরা এটিকে কিভাবে লুকিয়ে রাখা যায় তা নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। যাতে এটা কেউ দেখতে না পারে। আমরা একটা কোড তৈরি করলাম এবং একপর্যায়ে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে গেলাম।’

আমজাদ ও তার ভাই বাসিত তখন এই সফটওয়্যার তৈরি করে সেগুলো বিক্রি করতে লাগলেন। তাদের ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল। তিনি বলেন, আমাদের এক ডাক্তার বন্ধুর কাছ থেকে একটি অর্ডার পেলাম। দরদাম ও খরচ নিয়ে আলোচনা করার সময় তিনি বললেন, তাদের বাজেট খুব সীমিত। তাই তিনি খুব অল্প খরচে এই সফটওয়্যার তৈরির করতে বললেন।

আমি বললাম ঠিক আছে। তবে আমরাই এই কোডের মালিক থাকবো এবং আপনি সেটা কোথাও বিক্রি করতে পারবেন না। কাউকে দিতেও পারবেন না। এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি লেখার ব্যাপারে আমরা খুব বেশি দক্ষ ছিলাম না। সেসময় পাকিস্তানে সাইবার আইনও ছিল না। কোড কিভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবে সেবিষয়েও আমাদের ধারণা ছিল না।

তাই তাদের তৈরি কোড কপি না করার ব্যাপারে তারা তাদের ডাক্তার বন্ধুকে সতর্ক করে দিলেন। বললেন, ‘আপনি যদি কপি করেন তাহলে কিন্তু এটা ছড়িয়ে পড়বে। ওই বন্ধু তাতে রাজিও হলেন।’

হঠাৎ আমেরিকা থেকে ফোন
তাদের সতর্কবার্তা খুব পরিষ্কার ছিল। কিন্তু এর পরে একদিন হঠাৎ করেই একটা ঘটনা ঘটলো। সেদিন তিনি একটু বেশি রাত পর্যন্তই কাজ করছিলেন।

আমজাদ বলেন, ‘আমি দিনে প্রায় ১৮ ঘণ্টা কাজ করি। সেদিন ঘুমানোর জন্য চেয়ার ছেড়ে আমি ম্যাট্রেসের ওপর শুয়ে পড়ি। মধ্যরাতের দিকে, সম্ভবত ভোর ৩টা কী ৪টা হবে, একটা ফোন এলো। রিসিভার তোলার পর শুনতে পেলাম ওপাশে একজন নারী ইংরেজিতে কথা বলছেন। তিনি জানতে চাইলেন- এটা কি ব্রেইন কম্পিউটার। আমি বললাম হ্যা, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’

তিনি বললেন, তার কম্পিউটারে একটা সমস্যা হচ্ছে এবং সেখানে বলা হচ্ছে তিনি যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কোত্থেকে ফোন করছেন। তিনি বললেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এখন মনে করতে পারছি না।

আমজাদ বলেন, তিনি তার বিভাগের নিউজলেটারের জন্য একটা লেখা লিখছিলেন কিন্তু হঠাৎ করেই কম্পিউটারে সমস্যা দেখা দেয়। তাই তিনি তার ফাইল সেইভ করতে পারছেন না। তখন আমার মনে হলো- ওহ মাই গড, তার কম্পিউটারে হয়তো কোনো ভাইরাস ঢুকে পড়েছে।

জিজ্ঞেস করলাম তিনি কোনো ফ্লপি চেঞ্জ করেছেন? তিনি বললেন, আমি এসবের কিছু বুঝি না, আপনি শুধু বলেন আমি এটা থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারি। আমাকে লেখাটা সেভ করতে হবে। আমি জানতে চাইলাম আমার ফোন নম্বর তিনি কোথায় পেয়েছেন। তিনি বললেন তার একজন সহকর্মী ফ্লপির ভেতরে আমার নাম ও যোগাযোগের নম্বর খুঁজে পেয়েছেন।

আমজাদ তার ডাক্তার বন্ধুকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তার জন্য তৈরি কোডটি যেন কপি করা না হয়। তবে আমজাদ তখন বুঝতে পারলেন যেভাবেই হোক সেটা কপি করা হয়েছে। কারণ এই কোডটি বিশ্বের বিভিন্ন কম্পিউটারে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং সেসব কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটি বার্তা ভেসে উঠছে।

ভয়াবহ সেই বার্তা
বার্তাটি ছিল এরকম, ‘ওয়েলকাম টু দা ডানজান। ভূগর্ভস্থ অন্ধকারে আপনাকে স্বাগতম। কপিরাইট- ১৯৮৬। বাসেত এন্ড আমজাদস ব্রেইন কম্পিউটার সার্ভিসেস। সেভেন থ্রি জিরো লাহোর, পাকিস্তান। তারপর একটি ফোন নম্বর- ফোর থ্রি জিরো ভাইরাসের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। প্রতিষেধকের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।’

দেখা গেল তাদের তৈরি ব্রেইন ভাইরাসটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, চীন, সিঙ্গাপুরেও ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আমজাদ ফারুক আলভী জানতেন, তার ব্রেইন ভাইরাস ক্ষতিকর ছিল না। কিন্তু সবাই ভাইরাসটিকে এভাবে দেখেনি। ১৯৮৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনে ভাইরাসটিকে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করা হলো।

আমজাদ বলেন, ‘এটা সত্য ছিল না। কোনো কিছুর ক্ষতি কিংবা কিছু চুরি করার জন্য এই ভাইরাস বা কোডটি তৈরি করা হয়নি।’ একদিকে এটা যেমন পার্সোনাল কম্পিউটারের প্রথম ভাইরাস, তেমনি এই প্রথম কোনো ভাইরাসের ব্যাপারে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। এটা অস্বাভাবিক। কারণ যারা ভাইরাস তৈরি করবে তারা কখনোই চাইবে না যে কেউ তাদের শনাক্ত করুক।

এই ঘটনার পরও আমজাদ ও বাসিত দু’ভাই তাদের ব্রেইন কম্পিউটার নিয়ে কাজ চালিয়ে গেলেন পরে যা পাকিস্তানের একটি বৃহৎ টেলিযোগাযোগ কোম্পানিতে পরিণত হয়।

আমজাদ ফারুক আলভী বলেন, আল্লাহর দয়ায় আমরা তিনজন এখনও আছি। আমরা আমাদের কাজ খুব উপভোগ করি। খুব অল্প আয় হয় আমাদের। কিন্তু কাজ করে যে আনন্দ পাই সেটা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের পুরো কর্মজীবনে এই ভাইরাসটি খুবই ছোট্ট, খুবই ক্ষুদ্র একটি ঘটনা।

Scroll to Top