পবিত্র মাহে রমজানের ইফতারে অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। খেজুর খেয়ে রোজা ভাঙার চল বিশ্বজুড়েই, বাংলাদেশেও এর বাইরে নয়। সাথে এর ধর্মীয় তাৎপর্য তো আছেই। এছাড়া খেজুরের পুষ্টিগুণও গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য প্রতিবছর রমজানকে ঘিরে বাজারে খেজুরের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু রোজাদারদের সেই প্রিয় খেজুর ইফতারের পাতে রাখা যেন দিন দিন কঠিনই হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এই যেমন, রোজায় খেজুরের যে জাতটি মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে সেটির নাম ‘জাহিদি’। যেটি গত রমজানে কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতেই সেই জাহিদি খেজুরের দাম দ্বিগুণ বেড়ে খুচরা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা পর্যন্ত। শুধু জাহিদি নয়, এবার সব ধরনের খেজুরই বিক্রি হচ্ছে চড়া মূল্যে। ভালোমানের খেজুর এক বছরের ব্যবধানে ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যাওয়া প্রায় সব খেজুরই সৌদি আবরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আমদানি করা হয়। চট্টগ্রামের খেজুরের সবচেয়ে বড় বাজার ফলমণ্ডি ঘুরে দেখা যায়, এবার দাবাস খেজুর বিক্রি হচ্ছে হচ্ছে ৪৫০ টাকায়, যা গেল বছর বিক্রি হয়েছিল ২৮০ টাকা। অন্য দিকে বরই নামের খেজুরটিও ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়। এ বছর আজওয়া, মরিয়ম ও মাবরুম জাতের খেজুরের চাহিদা রয়েছে বাজারে অনেক। এক বছরে এসব খেজুরের দামও অনেক বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি আজওয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১০০০-১১০০ টাকা, যা গত বছর কেজি প্রতি ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা বিক্রি হয়েছিল। মাবরুম বিক্রি হচ্ছে ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা। মরিয়ম বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। আর মানভেদে প্রতিকেজি মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। আলজেরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪০০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব খেজুরের দামই বেড়েছে। কোনো কোনো খেজুরের দাম কেজিতে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এখন ৩০০ টাকার নিচে খেজুর বিক্রি করা যায় না। অনলাইনে যারা খেজুর বিক্রি করে তারা আরও বেশি দামে বিক্রি করে। বিশ্ব বাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এবং আমদানিতে বাড়তি শুল্কের কারণে এবছর খেজুরের দাম বেশি পড়ছে।
কিন্ত রমজানের বর্ধিত চাহিদা বিবেচনায় এবং বাজার স্বাভাবিক রাখতে খেজুর আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি (শুল্ক) ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার। এরপরেও খেজুরের দামে এর প্রভাবে দেখা যায়নি। উল্টো আরও বেড়েছে।
চট্টগ্রামের ফলমণ্ডির মেসার্স আর এন জেনারেল ট্রেডিংয়ের মালিক রহমত আলী বলেন, বর্তমানে বাজারে সৌদি আরবের খেজুরের দাম বেশি। তবে শুল্ক বাড়ানোর কারণে এ বছর খেজুরের ব্যবসা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, সবচেয়ে কম দামি খেজুরে বর্তমানে এনবিআর ১৭০ টাকার মধ্যে ৩০ টাকা ডিউটি কমিয়েছে। এতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। আমরা যে দামে পণ্য আমদানি করে থাকি, সেই দামে শুল্কায়ন করা হলে দাম অনেক কমে যেত। ভোক্তারা এর সুবিধা পেত। আমরাও পণ্যগুলো বিক্রি করতে পারতাম। এখন আমদানি করা পণ্য এত টাকা ডিউটি দিয়ে বিক্রি করতে পারব কিনা, তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।
খেজুর ব্যবসায়ী আমিন মোল্লা বলেন, পাইকারি পর্যায়ে কেজি প্রতি জাহিদি খেজুর বিক্রিতে দাম পড়ে ২৫০, দাবাস ৩৫০, দাবাস ক্রাউন ৪০০-৪৫০, মেডজুল ১২০০, মরিয়ম ৯০০-১০০০, সাফাভি ৭০০-৮০০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারা তাদের অন্যান্য ব্যয় যুক্ত করে নিজ নিজ হিসাবে এসব খেজুরের দাম ধরে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার ১০ শতাংশ শুল্ক কমালেও সেটি সার্বিকভাবে দাম কমাতে ভূমিকা রাখছে না। কেননা সৌদি আরব ও মিশর থেকে খেজুর আমদানি হলেই ৪০০০ ডলার অ্যাসেসমেন্ট করা হচ্ছে।’
যেসব দেশ থেকে খেজুর আমদানি করা হয়, সেসব দেশে আমাদের মিশন ও রাষ্ট্রদূতরা রয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কমার্শিয়াল কাউন্সেলররাও আছেন। তাদের কাছে জেনে প্রকৃত দাম ধরে শুল্কায়ন করার কথা বলেন এই ব্যবসায়ী।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মিনহাজুল ইসলাম। খেজুরের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর রোজায় দুবোনকে কাঁচা ইতফারির সঙ্গে খেজুরও দিয়ে থাকি। প্রতিবার দুই কেজি করে দিয়েছি। তবে এবছর বাজারে খেজুর কিনতে গিয়ে দাম শুনে অবাক। যে খেজুর গত বছর ১৮০ টাকায় কিনেছি সেটি নাকি ৩২০ টাকা। বোনদের শ্বশুর বাড়িতে যেহেতু দিবে হবে বাধ্য হয়ে এক কেজি ৩১০ টাকায় নিয়েছি। রমজানে আমাদের দেশে সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। আমরা সাধারণ মানুষ অসহায়।’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস.এম নাজের হোসাইন বলেন, সরকার শুল্কে ছাড় দিয়েছে। শুল্কায়নের কারণে কতটুকু দাম বাড়তেছে এবং সরকার কতটুকু শুল্ক পাচ্ছে তা বিষয়টি সাধারণ মানুষকে জানানো দরকার। এ বিষয়ে এনবিআরকে উদ্যোগী হতে হবে। ১০০ টাকা দরে খেজুর আমদানি করে সেটি ৮-৯শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে এরকম দৃষ্টান্তও কিন্তু আমাদের কাছে আছে। এবার শুল্কের দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীরা বাজারে অনেক আগে থেকে খেজুরের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটছে কিনা সেদিকে সরকারকে নজর দেওয়া উচিত।
নাজের হোসাইন আরও বলেন, খেজুরের যথাযথ শুল্কায়ন না হওয়ার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। বাড়তি শুল্কায়নের কারণে কম দামে আমদানি করা খেজুরে দিতে হচ্ছে বাড়তি মূল্য। সেই সুযোগে বড় মুনাফা করছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে এক ধরনের ব্যবসায়ী এবছর খেজুরের আমদানিতের শুল্কায়ন বেশি হচ্ছে এ কথা বলে খেজুরের দাম ৩-৪ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শুল্ক কমানো আগে অনেকগুলো খেজুর খালাসের অপেক্ষায় ছিল। এখন ব্যবসায়ীরা বলতে শুরু করছে শুল্কায়ন কমানোর পরও দামের নাকি তেমন প্রভাব পড়েনাই।
দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৭০-৯০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে শুরু রোজার মাসেই ৪০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা থাকে। এর বিপরীতে ২০২২ সালে আমদানি হয়েছে সাড়ে ৮৮ হাজার মেট্রিকটন। আরও গেল বছরে আমদানি হয়েছিল সাড়ে ৬৮ হাজার টন।
কাস্টমস সূত্র জানায়, রমজানের জন্য বছরের প্রথম দুমাসে অর্থান জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়েছে ২৪ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন খেজুর। যার ৯৫ শতাংশ ইতিমধ্যে খালাস করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয়েছে ৩৯ হাজার ১৪০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে আমদানি হয় ৬ হাজার ১৬ মেট্রিক টন। জানুয়ারি মাসে খেজুর আমদানি হয় ৬ হাজার ১৬৯ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে খেজুর আমদানি হয় ২৬ হাজার ৯৫৫ মেট্রিক টন।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিন মাসে ৩৯ হাজার মেট্রিক টন আমদানি হলেও এর বিপরীতে শুল্কায়ন হয় কম। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৫-৬ কন্টেইনার খেজুর শুল্কায়ন করা হতো। কিন্তু গত ১০-১৫ দিন ধরে এর পরিমাণ বেড়ে গেছে। এখন গড়ে প্রতিদিন ৫০-৬০ কন্টেইনার খেজুর শুল্কায়ন করা হচ্ছে। প্রতিটি কন্টেইনারে ২৪ থেকে ২৫ মেট্রিক টন খেজুর থাকে, সেই হিসেবে গত তিন মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন খেজুর শুল্কায়ন করা হয়। বাকি খেজুরগুলো এখন পড়ে আছে বিভিন্ন কন্টেইনার ডিপোতে।
শুল্কায়নের ক্ষেত্রে বেশি দাম ধরা হচ্ছে না দাবি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের উপকমিশনার ইমাম গাজ্জালীর। তিনি বলেন, ‘অ্যাসেসমেন্ট করার সময় খেজুরের মান যে গ্রেডে পড়ে, ওই গ্রেড অনুযায়ী নির্ধারিত শুল্কায়নমূল্য ধরে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। আমদানিকারকরা ঘোষিত মূল্যে দাম কম দেখালেও বাস্তবে অ্যাসেসমেন্ট করার সময় দেখা যায় সেগুলো উন্নতমানের খেজুর।’