গ্যাসের উত্তোলনযোগ্য মজুদ বেড়েছে ২ টিসিএফ!

গ্যাসের উত্তোলনযোগ্য মজুদ বেড়েছে ২ টিসিএফ!

দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) বেড়েছে। দেশের ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন শেষে অবশিষ্ট মজুদ প্রায় ৯ টিসিএফ এর উপরে রয়েছে বলে পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে।

বর্তমান দৈনিক (৪-৫ মার্চ) কমবেশি ২.১ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। সে হিসেবে বছরে উত্তোলনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দশমিক ৭৬ টিসিএফ। এই হারে উত্তোলন অব্যাহত থাকে, আর যদি নতুন আবিষ্কার না হয় তাহলে আগামী ১২ বছর পর গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে।

পেট্রোবাংলার ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী (৩১ ডিসেম্বর ২০২২) অবশিষ্ট গ্যাসের মজুদ ছিল ৮ দশমিক ৬৮ টিসিএফ। ওই হিসাবের পর সময় চলে গেছে আরও ১ বছর (২০২৩ সাল)। ওই বছর দেশীয় গ্যাসফিল্ডগুলো থেকে বছরে প্রায় ১ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করছে। অর্থাৎ সাড়ে ৮ টিসিএফ থেকে ১ টিসিএফ কমে গেলে মজুদ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৭ টিসিএফ।

কিন্তু সুখের কথা হচ্ছে বাংলাদেশ সম্প্রতি একটি গ্যাস ফিল্ড (ইলিশা-১) ও কয়েকটি জায়গায় নতুন স্তর আবিস্কার করেছে। এতে করে পুর্বের প্রাক্কলিত মজুদ প্রায় ২ টিসিএফ বেড়েছে পেট্রোবাংলা সুত্র জানিয়েছে।

পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, গ্যাসফিল্ডগুলোর অবশিষ্ট মজুদ রিভিউ করা হয়েছে। এতে মজুদ বেড়ে ৯ টিসিএফ এর উপরে গেছে। মজুদ রিভিউ সংক্রান্ত একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া গেলে পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটসহ সব জায়গায় হালনাগাদ করা হবে।

বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের হাতে থাকা দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসফিল্ড বিবিয়ানার রিজার্ভ বেড়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। কতটুকু বেড়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছেন, এই মুহুর্তে সঠিক ফিগার (অঙ্ক) মনে পড়ছে না। তবে তাদের মজুদ আগের চেয়ে বেড়েছে।

পেট্রোবাংলার গ্যাস মজুদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছে, বিবিয়ানার মজুদ প্রায় ১ টিসিএফ এর মতো হয়েছে। ২০২২ সালের রিপোর্টে তাদের অবশিষ্ট মজুদ ছিল ৩৩৩ দশমিক ৪৪ বিসিএফ। তারপর এক বছর ধরে দৈনিক কমবেশি ১০৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে তারা ৩৭৭ বিসিএফ উত্তোলন করেছে। এতদিনে ফিল্ডটির মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও উত্তোলন প্রায় আগের অবস্থানেই রয়েছে।

মজুদের হিসাব কয়েকটি সুত্র রয়েছে, একটি হচ্ছে প্রমাণিত মজুদ, সম্ভাব্য এবং সম্ভাবনাময় (৩পি)। প্রমাণিত এবং সম্ভাব্য মিলে উত্তোলনযোগ্য মজুদ নির্ণয় করা হয়। সম্ভাবনাময়কে সাধারণ বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

১৯৯৮ সালে আবিষ্কৃত গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড হিসেবে বিবেচিত। ৩পি যোগ করলে মজুদ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৪ বিসিএফ এরমধ্যে সম্ভাবনাময় মজুদ বিবেচনা করা হয় ১৩২৯ বিসিএফ। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস ফিল্ডটি থেকে ৫ হাজার ৪২২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে।

২০০৮ সালের ওই হিসাব নতুন কূপ খনন ও অন্যান্য সমীক্ষার মাধ্যমে নতুন মজুদ প্রাক্কলন করা হয়েছে। শেভরন বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই মজুদ বেশি রয়েছে বলে দাবী করে আসছিল। তাতে সায় ছিল না পেট্রোবাংলার। এবার পেট্রোবাংলার কর্তৃক অনুমোদন, এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ঘুরে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) দপ্তরে পৌঁছে গেছে। ফাইল নেমে আসলেই ঘোষণা দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ভু-খন্ডে ১১৩বছরে (প্রথম কূপ খনন ১৯১০সাল) মাত্র ৯৮টি অনুসন্ধান কূপ খননের মাধ্যমে ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার হয়েছে। মোবারকপুর ও কশবার মতো কয়েকটি ফিল্ড যেগুলোতে গ্যাসের আঁধার পেলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করা হয়নি। অন্যদিকে ত্রিপুরা ছোট্ট জায়গায় ১৫০টির অধিক অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। যে কারণে বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এখনও তিমিরেই বলে বিবেচনা করা হয়। গ্যাস সংকট দূর করতে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকতে হয়েছে বাংলাদেশকে। যে কারণে টালমাটাল হয়ে উঠেছে দেশের জ্বালানির বাজার। দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

দেশে গ্যাস সংকটের জন্য অনুসন্ধান স্থবিরতাকেই দায়ী করে আসছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘদিন ধরে পেট্রোবাংলার ঢিলেমির কারণে অনেকেই সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তবে সেইদিন এখন বদলে যেতে শুরু করেছে। আড়মোড়া ভেঙে বুলেট গতিতে ছুঁটতে শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। একদিকে যেমন গতিময় হয়েছে, অন্যদিকে নতুন মাত্রাও যুক্ত হয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে।

এতোদিন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আটকে ছিল বাংলাদেশ। আরও ছোট করে বলতে গেলে সুরমা বেসিন তথা, সিলেট থেকে শুরু করে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এবং ভোলার মধ্যে আটকে ছিল বাংলাদেশ। অন্যান্য এলাকায় কিছু অনুসন্ধান কার‌্যক্রম হলেও তার পরিমাণ নগণ্য বলাই যায়। সেখানেও আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা।

চলমান ৪৬ কূপ প্রকল্পের সঙ্গে আরও দু’টি যুক্ত করা হয়েছে। দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চলছে ৪৮ কূপ খনন প্রকল্প, ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে। ইতোমধ্যেই ওই কর্মসূচির সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। ১০টি কূপের মাধ্যমে দৈনিক ১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা বেড়েছে বাংলাদেশে। দৈনিক ১০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বৃদ্ধির আশা করা হয়েছিল। সেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েছে ৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস বেশি পাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে।

৪৮ কূপ খনন প্রকল্পের পাশাপাশি ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে আরও ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এ জন্য তিন শতাধিক সম্ভাবনাময় এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০০টি কূপ চুড়ান্ত করা হবে। এ জন্য একটি কোর কমিটি কাজ করছে।

বাংলাদেশে আবিস্কৃত ২৯টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ২০টি থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। পাইপলাইন না থাকাসহ নানা কারণে ৪টি গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। আর সাঙ্গু, ছাতক, কামতা, ফেনী ও রূপগঞ্জ সাময়িকভাবে উত্তোলন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর‌্যন্ত সর্বোমোট ১৯.৯৪ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে দেশীয় গ্যাস ফিল্ড থেকে।

Scroll to Top