চট্টগ্রামে শুক্রবার বিকেলে শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। ২০২১ সাল থেকে নগরীর জিমনেশিয়াম মাঠে সমন্বিতভাবে এই বইমেলার আয়োজন করে আসছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। তখন থেকে প্রতিবারই মেলার আগে জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে মাঠটিতে বইমেলার আয়োজন করা হয়। ভিন্ন কিছু ঘটেছে এ বছর। দর কষাকষি করেও এবার জিমনেশিয়াম মাঠ পায়নি আয়োজকরা। তাই মেলা বসে রেলওয়ের জায়গা সিআরবি শিরীষতলায়। মাঠ বদলে নতুন কোনো মাঠে হচ্ছে চট্টগ্রামের বইমেলা। আগের বছরের তুলনায় কমেছে মেলার মাঠের পরিধি সঙ্গে কমেছে প্রকাশনীর সংখ্যাও।
জিমনেসিয়ামের প্রায় ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ বর্গফুটের মাঠে বদলে এবার মেলা চলছে মাত্রা ৪৩ হাজার বর্গফুটের মাঠে। একই সাথে গতবারের চেয়ে ১৬টি প্রকাশনী কমে এবার মেলায় ঢাকা-চট্টগ্রামের ৯২ প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছে। মাঠের পরিধি কমলেও গেল বারের চেয়ে ১৫ বেশি স্টল বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার বইমেলা ঘুরে দেয়া যায়, সিআরবির শিরীষতলা ঠিক দক্ষিণ পাশে অনুষ্ঠানের জন্য করা হয়েছে বড় মঞ্চ। যেখানে প্রতিদিন মেলাকে ঘিরে নানা আয়োজন চলবে। তার ঠিক পশ্চিমে পাশে শিশুদের জন্য কিড্স জোন করা হয়েছে। যেখানে বাচ্চাদের নানা ধরনের বাইডসহ খেলনা জিনিস রাখা আছে। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য শিরীষতলায় করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। পাশেই মেলায় আগতে দর্শনার্থীদের জন্য সেলফি জোন ও বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া মেলায় ছয়টি পৃথক খাবারের দোকান হয়েছে।
এদিকে প্রথমদিন ছুটির দিন হওয়াতে মেলায় দর্শনার্থীর উপস্থিতি ছিল বেশি। তাদের বড় একটি অংশ স্টল, বই ও প্রকৃতি নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন।
প্রথম দিনেও চালু হয়নি স্টল:
মেলার প্রথম দিনেও মানুষের ভিড়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি স্টল তৈরির কাজ করতে দেখা যায়। এসব স্টল থেকে নিজের পছন্দের লেখককের বই নিতে এসে অনেকে ফেরত যায়। প্রকাশনী সংশি্লষ্টরা মেলার আয়োজকদের থেকে স্টল পেতে দেরি হওয়ার কারণকেই দায়ী করলেও বেশ কয়েকজন আবার নিজেদের ব্যর্থতার কথা জানান।
এদিন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও স্টল ডেকোরেটরের কাজ শেষ করতে পারেনি অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনী। তাদের এক প্রতিনিধি জানান, ‘আমরা এখনো স্টল তৈরি করতে পারিনি সেটি আমাদের ব্যর্থতা।’ এসময় ওই স্টলে এসে অনেককে বই না পেয়ে ফেরত যেতে দেখা যায়।
আয়োজকদের থেকে স্টল পেতে দেরি হওয়ায় স্টল তৈরি শেষ করতে পারেনি অন্যধারা প্রকাশনী। তাদের স্টল তৈরির দায়িত্বে থাকার ইমরান খান নামের এক প্রতিনিধি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘যারা মেলা পরিচালনা করেন তাদের জন্য আমাদের দেরি। তারা মেলা শুরুর দুদিন আগে স্টল লটারি করে বুঝিয়ে দেন। একটি স্টল রেডি করতে কমপক্ষে ৪ দিন সময় লাগে। এখন মেলায় অনেক পাঠক এসে ফিলে যাচ্ছেন। তাদেরকে বই দিতে না পেরে আমাদেরও মন খারাপ হচ্ছে। আশা করছি সামনে থেকে আয়োজকরা বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।’
মাঠ বলদ নিয়ে যা বলছে প্রকাশনা সংশি্লষ্টরা:
টানা কয়েক বছর জিমনেশিয়ামে বইমেলার পর এবার মাঠ বদলে তা হচ্ছে সিআরবিতে করা হচ্ছে। এনিয়ে মেলা জমানো ও বই বিক্রিতে প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্রকাশনা সংশ্লিষ্টরা। আবার অনেকে মাঠ বদল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থায়ী মাঠের দারিও জানিয়েছেন। তবে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম নৈর্সগিক এলাকা সিআরবিতে মেলা জমে উঠবে বলে আশা করছেন আয়োজকরা।
মেলায় অংশ নেওয়া চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী চৌধুরী ফাহাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বইমেলায় অংশ নিয়ে যেটি দেখেছি, ফেব্রুয়ারি মাস আসলে কাউকে নতুন করে জানতে হয় না বইমেলার জন্য কোথায় যাব। এটা একদম সবারই জানা যে, বইমেলা মানে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আর চট্টগ্রামে ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কয়েক বছর পরপর জায়গা স্থানান্তর হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমরা শহরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থাকতে পারছি না। গত চার বছর ধরে জিমনেশিয়ামের মাঠে মেলা হচ্ছিল, সেটি মানুষের কাছে মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। কিন্তু এবার তা সিআরবিতে নিয়ে আসা হল। এটিও একটি জমজমাট জায়গা। মানুষ বিকেলে ঘুরতে আসে। এরপরও আমরা নিশ্চিত নয় যে আগামীতে এখানে হবে। বইমেলার মেলার জন্য স্থায়ী মাঠ করা হোক সেটাই আমাদের দাবি থাকবে।’
প্রকাশনা পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি রেহেনা চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমাদের এই বইমেলা নিয়ে বহুদিন ধরে ঘুরাঘুরি করতেছি। একেক সময় একেক জায়গা পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। নতুন জায়গা যেহেতু একটু সমস্যা হবে। পাঠক বা ক্রেতা তাদের মাঝেও এটির প্রভাব পড়বে। তাছাড়া এটি জিমনেশিয়ামের চেয়ে ছোট মাঠ। আশা করছি সামাজিক মাধ্যম ও মিডিয়াতে প্রচারের মাধ্যমে এ মেলা আরও জমে উঠবে।’
মেলার স্থায়ী মাঠ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক আবুল বাসা মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের খাম খতিয়ানভুক্ত কোনো জায়গা যদি সিটি করপোরেশন পছন্দ করে দেয়। সেখানে আমরা স্থায়ীভাবে বইমেলাসহ সব ধরণের মেলার জন্য ব্যবস্থা করতে পারি।’
মেলার নিরাপত্তার বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, ‘সিআরবির এখান অতিরিক্ত কিছু নিরাপত্তার দরকার আছে। মেলার আয়োজকরা যদি আমাদের কিছু লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমরাও সেটির ব্যবস্থা করতে পারব।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘শহরের লোকসমাগম হবে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব এমন কোনো জায়গা নেই। যেগুলো আছে সেখানে বইমেলা করার মত না, করলেও জমবে না। তাই এবার আমরা জিমনেসিয়ামে জায়গা না পেয়ে রেলওয়ের মাধ্যমে সিআরবির জায়গাটি পেয়েছি। তাই রেলওয়েকে ধন্যবাদ জানাই। সিরআরবির নৈসর্গিক সৌন্দর্যে কবিরা কবিতা লিখবেন, পাঠক-লেখক আড্ডা দেবেন। এখানে অন্যরকম একটি পরিবেশ তৈরি হবে। আমরা আশা করছি সিআরবিতে বইমেলা জমে উঠবে। আগামীতেও আমরা এখানে বইমেলা করার চেষ্টা করব।’
চসিকের আয়োজনে চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতায় এ বইমেলা হচ্ছে। এবারের বইমেলার বাজেট ৫০ লাখ টাকা। এবারও জাতীয় জীবনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য একুশে সম্মাননা স্মারক পদক ও সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হবে।
মেলার আয়োজনের ২৩ দিনজুড়ে রবীন্দ্র উৎসব, নজরুল উৎসব, লোক উৎসব, মরমি উৎসব, বসন্ত উৎসব, তারুণ্যের উৎসব, নৃগোষ্ঠী উৎসব, শিশু উৎসব, লেখক সমাবেশ, যুব উৎসব, নারী উৎসব, চাটগাঁ উৎসব, মুক্তিযুদ্ধ উৎসব, পেশাজীবী সমাবেশ, কবিতা আবৃত্তি ও ছড়া উৎসব, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, কুইজ প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, গুণিজন সংবর্ধনা, সম্মাননা পদক এবং সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।
আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বইমেলা চলবে।