নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার পূর্বাংশ দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা নদীর শাখা নদী বুড়ি তিস্তা। এই নদীর ওপারে উপজেলার গোলমুন্ডা,ডাউয়াবাড়ি,শৌলমারী, কৈমারী ও পার্শ্ববর্তী জেলা লালমনিরহাটের ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের ২২ গ্রামের প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের বাস। বুড়ি তিস্তা নদীর উপর সেতু না থাকায় এ নদীর মনছারের ঘাট নামক স্থান দিয়ে জেলা শহর, উপজেলা শহর বা স্কুল কলেজ যাতায়াতে বর্ষায় নৌকা ও খরা মৌসুমে বাঁশ বা কাঠের সাঁকোতে টোল দিয়ে চরম দুর্ভোগে চলাচল করতে হয় স্থানীয়দের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নীলফামারী-৩ আসনে ১৯৮৬ সালের সংসদ সদস্য জোবান উদ্দিন আহম্মেদসহ ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টির নির্বাচিত সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল (অব.) পর্যন্ত ৩২ বছরে নির্বাচিত সকল সংসদ সদস্যই মনছারের ঘাটে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও, কথা রাখেনি কেউ। ফলে বুড়ি তিস্তা নদীতে সেতু না থাকায় স্বাধীনতার এত বছরেও উপজেলাটির বৃহৎ এই অংশে এখনো লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া।
এলাকাবাসী বলছেন, উপজেলার চার ইউনিয়নের বৃহৎ ওই অংশে যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় গড়ে উঠেনি তেমন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকে পড়াশুনার তাগিদে এ অঞ্চলের প্রায় ৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে ঝুঁকি নিয়েই পার হতে হয় বুড়ি তিস্তা নদী। ফলে প্রতি বছর নৌকা ডুবি, ব্রিজ ভাঙাসহ নানা দুর্ঘটনার স্বীকার হয় শিক্ষার্থীরা।
শুধু শিক্ষা ব্যবস্থাই নয় রাস্তাঘাট না থাকায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় একাধিক সেবা থেকে বঞ্চিত ওই অঞ্চলের মানুষ। যাতায়াত ব্যবস্থার বেহাল দশার ও প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট না থাকায় আবাদি জমির পাশ ও নদী রক্ষা বাঁধ দিয়েই চলাচল করে এসব এলাকার মানুষ। ব্রিজ ও রাস্তার অভাবে কৃষিনির্ভর এলাকার ধান , ভুট্টা ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর বিক্রিতে মোটা অঙ্কের লস গুনতে হয় কৃষকদের।
এদিকে সেতু ও রাস্তা না থাকায় অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে বিপাকে পড়তে হয় বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে। উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবে অসুস্থ রোগীদের সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিতে দেরি হওয়ায় মৃত্যুও হয়েছে অনেকের বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ডাউয়াবাড়ি মেম্বার পাড়ার বাসিন্দা ইয়াসিন আলী বলেন, ‘এখন হামা বাশের পুলে চলাচল করিছি। বর্ষায় নৌকাত করি যিই। ৫৫ বৎসরে ৮ বার নৌকা ডুবি নদীত পরনুং। সবায় ভোটের সময় আইসে, ভোট নেয় আর পালায়। মরার আগে এই পুল দেখা হইবে না কথা কয় লাভ নাই।’
স্কুল শিক্ষক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আর আমরা স্বাধীনতার পর থেকেই অবহেলিত আছি, হয়ত আগামীতেও থাকতে হবে। নদীর ওপারে আবাদি প্রতিটা পণ্যের দাম আমরা কম পাই। এই এলাকার কৃষকরা প্রতি বছরেই লোকসান গুনে। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। অনেক অসুস্থ নারীর মৃত্যু হয়েছে রাস্তা ও ব্রিজের অভাবে। আমাদের জোড়ালো দাবি যত দ্রুত সম্ভব বুড়ি তিস্তার এই অংশে ব্রিজ নির্মাণের।’
একই এলাকার মজিবর রহমান বলেন, ‘জোবান এমপি আসছিল আসি কইছে এঁটে ব্রিজ হইবে, এই হইবে কথা সবায় কয়, মোস্তফা এমপি আসি মাপি গেলো কাজ আর হইল না, রানা এমপিক তো দেখোং(দেখি) নাই। হামা বাঁচি থাকাতে মনে হয় এই ব্রিজ দেখির পামো না। কত মহিলা প্রসব বিষ (ব্যথা) উঠে যাইতে যাইতে একটা দুর্ঘটনা ঘটি যায়। হামা আশা ছাড়ি দিছি।’
জলঢাকা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শেষ থাকেনা। পরিক্ষা বলেন বা কলেজের ক্লাশ কোনটিতে সঠিক সময়ে পৌচ্ছানো দুষ্কর। ছোটবেলা থেকে চরম দুর্ভোগে পড়াশুনা করছি। একটা ব্রিজ হলে এই অঞ্চলের মানুষ অন্তত রাস্তাঘাটের সেবাটা পাবে। এটা হওয়া জরুরি।’
নেকবক্ত বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খুশি মনি বলেন, ‘রাস্তা না থাকায় আমাদের ৩ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে আসতে হয়। এখন রাস্তা ধুলা দিয়ে ভর্তি। বর্ষায় বই ভিজে যায়। স্কুলে আসতে আসতে দুইটা ক্লাস চলে যায়। আমরা ছোট মানুষ কি বলব। একটা ব্রিজ হলে আমাদের এলাকাটা উন্নত হতো।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুকুল ইসলাম বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা আসেন এলাকার উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করি কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না৷ বার বার যোগাযোগ করেছি এই ব্রিজ টার জন্য কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। ব্রিজটা হলে এখানে সড়ক নিমান হতো , মূলত বুড়ি তিস্তার ব্রিজ পারে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বদলাতে। পরিষদের তো এত পরিমাণ বাজেট নেই সেখানে ব্রিজ নির্মাণের৷ তবে আশাবাদী বর্তমান এমপির সময়ে এটি বাস্তবায়ন হবে।’
এলাকার রাস্তাঘাটের বেহাল দশার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে টিআর কাবিটাসহ স্থানীয় সরকারের আওতায় যে উন্নয়ন বরাদ্দ ছিল সেগুলোতে সংসদ সদস্যদের কোন তদারকি ছিল না। আমরা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছিলাম। তবে এখন এগুলা সংসদ সদস্য নিজেই বরাদ্দ দেন ফলে আমরা এলাকার তেমন কাজ করতে পারি না।’
ব্রিজের বিষয়ে নীলফামারী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফিরোজ হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘মনছারের ঘাটের ব্রিজ নির্মাণে এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তবে যে সকল স্থানে ব্রিজ প্রয়োজন সেই তালিকা পাঠানো হয়েছে।’
তবে মনছারের ঘাটে ব্রিজ নির্মানের প্রস্তাবনা তৈরিসহ এবং ওই এলাকায় সংযোগ সড়ক নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য সাদ্দাম হোসেন পাভেল।
তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘জলঢাকা উপজেলার ওই অংশে কিছুটা অবহেলিত আছে, অবহেলিত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে কাজ করব। এছাড়া মনছারের ঘাটে ব্রিজ নির্মাণে ইতিমধ্যে আমি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে সংযোগ সড়ক নেই । সংযোগ সড়ক ও ব্রিজের প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’