আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। টানা তৃতীয়বারের মতো বেসামরিক সংসদে ভোট দিতে চলেছে দেশটির জনগণ। বহু আলোচনা, সমালচনা এবং নাটকীয়তায় জড়ানো এই নির্বাচনে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচিত হচ্ছেন ৫ রাজনৈতিক নেতা।
সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার একটি বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৪ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত তরুণ এবং প্রবীণ ৫ জন রাজনৈতিক নেতার নাম। এই ৫ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সকলেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী না হলেও, তারাই পাকিস্তানের নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে যাচ্ছেন।
নওয়াজ শরীফ
ভুট্টো পরিবারের নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মোকাবেলায় পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন নওয়াজ শরীফ। পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি।
৭৪ বছর বয়সী নওয়াজ শরিফ ইতিমধ্যেই ৩ বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও প্রতিবারই তিনি ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০১৩ সালে শেষবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সেনা নিয়ন্ত্রিত দেশটির সামরিক বাহিনীর সুনজর পেতে ব্যর্থ হন তিনি। দেশকে সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত করে বৈদেশিক ও নিরাপত্তানীতি প্রণয়ন এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে গিয়েই বিদায় ঘণ্টা বাজে তার।
২০১৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগ এনে নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) সমর্থন দেয় দেশটির সেনাবাহিনী। অপরদিকে নওয়াজ শরিফকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এসব দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় নির্বাসন গ্রহণ করেন তিনি।
ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) চাপে ফেলে নির্বাসন থেকে ফিরে নিজ দল পিএমএল-এন এর হয়ে আবারও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতা হওয়ার মঞ্চ তৈরি করেছেন নওয়াজ শরিফ। প্রবীণ এই নেতাকে প্রধানমন্ত্রী পদে লড়াই করার জন্য তার পথের সমস্ত বাধা দূর করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সুপরিচিত ভুট্টো পরিবারের সন্তান, ৩৫ বছর বয়সী তরুণ রাজনীতিবিদ বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। মাত্র ৭১ দিন বয়সে তার মা বেনজির ভুট্টো মুসলিম বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার দাদা জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭০ এর দশকে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার পিতামহ শাহ নওয়াজ ভুট্টো ছিলেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের একটি রাজ্য, জুনাগদহের প্রধানমন্ত্রী। বিলাওয়ালের বাবা আসিফ জারদারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে মা বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের পরপরই তিনি পারিবারিক দল পিপিপির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে বিলাওয়াল, শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে পাকিস্তানের সর্বকনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদে লড়বেন।
করাচিভিত্তিক নির্বাচন বিশ্লেষক আবদুল জব্বার নাসির বলেছেন, বিলাওয়াল জানেন যে তার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই তিনি নির্বাচনের পর প্রধান বিরোধীর ভূমিকার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
ফজল উর রেহমান
পাকিস্তানের রাজনীতিতে মাওলানা নামে পরিচিত ৭০ বছর বয়সী ফজল উর রেহমান। তিনি পাকিস্তানের বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জমিয়ত উলেমা ই ইসলাম-ফজলের সভাপতি। ধর্মীয় শিক্ষার কারণেই তিনি মাওলানা নামে পরিচিত। তিনি পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া) সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মেহমুদের সন্তান।
রেহমান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং কাশ্মীর ও পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট, ১৩-দলীয় জোটের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই জোটই ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়। রেহমান দেশটির পরবর্তী রাষ্ট্রপতির জন্য মনোনীত হবেন বলে প্রত্যাশিত।
তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকা সামরিক সংস্থা হয়তো তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ নাও করতে পারে।তবে যেভাবেই হোক না কেন, রেহমান পাকিস্তানের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবেন।
মরিয়ম নওয়াজ
পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচনে বিশেষভাবে আলোচনায় আছেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নওয়াজ শরিফের মেয়ে ৫০ বছর বয়সী মরিয়ম নওয়াজ। বর্তমানে তিনি নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এন-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সংগঠক। তাকে তার বাবার পর পার্টির ডি ফ্যাক্টো নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১৮ সালে, মরিয়মকে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের জন্য রাজনীতি থেকে অযোগ্য ঘোষণা করে তার বাবার মতো গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে তিনি ইমরান খান সরকারের একজন সোচ্চার সমালোচক হয়ে ওঠেন। খানের সরকার পতনের পর তার চাচা শেহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হলে, তিনি তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য করে তুলেন।
নওয়াজ শরীফ বর্তমানে মরিয়মকে দলের লাগাম টেনে ধরার এবং তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তৈরির পথ তৈরি করছেন। নির্বাচনে পিএমএল-এন এবং তার মিত্ররা জয়ী হলে তিনি পরবর্তী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীর তারিন
২০১১ সালে ইমরান খানের দল পিটিআইতে যোগ দেন জাহাঙ্গীর তারিন এবং ২০১৩ সালে এর সেক্রেটারি-জেনারেল হন। তিনিই ইমরান খানের পর দলটির দ্বিতীয় কমান্ড ছিলেন। ২০২১ সালে ইমরান খানের পতনের পর তিনি পিটিআই থেকে সরে আসেন এবং গত বছর পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক দল ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টির (আইপিপি) প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে পাকিস্তানের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তিনি দেশটির আসন্ন নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করছেন। ২০১৮ সালের মতোই ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পিটিআই প্রার্থীদের মধ্যে তারিন হতে পারেন একজন কিংমেকার।