ঢাকা, ১১ জানুয়ারি – জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান করলে তা হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা পরিপন্থি। সেই সঙ্গে তা নির্বাচকমণ্ডলীদের (ভোটারদের) সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের শামিল হবে।
১৯৯৬ সালে ডা. আলাউদ্দিন ও হাসিবুর রহমানের সংসদ সদস্য পদের বৈধতার চ্যালেঞ্জের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ সংক্রান্ত নীতি ঠিক করে দেয়। ফলে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা যদি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন তাহলে তাদের সদস্যপদও বাতিল হতে পারে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে রাজশাহী-৫ এবং সিরাজগঞ্জ-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ডা. আলাউদ্দিন ও হাসিবুর রহমান স্বপন। নির্বাচিত হওয়ার পর তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। ওই মন্ত্রিসভাকে তখন ‘ঐকমত্যের সরকার’ বলে অভিহিত করা হতো।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে- “নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’’
সংবিধানে বর্ণিত এই বিধান সরাসরি লঙ্ঘন করায় ডা. আলাউদ্দিন এবং স্বপনের সদস্যপদ চলে গিয়েছিল। আলোচ্য এই রিট মামলায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের লিখিত যে নির্দেশনা রয়েছে তা গ্রহণ করেনি আপিল। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আপিল বিভাগ ৭০ অনুচ্ছেদের অন্যরকম ব্যাখ্যা এবং অভিমত দিয়েছে।
জাসদের আ স ম আব্দুর রব, জাতীয় পার্টি থেকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং পরবর্তীতে বিএনপি’র এই দুই সদস্য যোগদান করেন। মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি এবং বিএনপি’র দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসদে কোনো ভোট দেননি। কিন্তু বিএনপি স্পিকারকে চিঠি দিয়ে তাদের সদস্যপদ শূন্য ঘোষণার জন্য বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে পাঠানোর দাবি জানায়।
তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী সংসদে এক রুলিং দিয়ে বিএনপি’র আবেদন খারিজ করে দেন। স্পিকার তার রুলিংয়ে বলেন, যেহেতু এই দু’জন সদস্য দলবদল করেননি এবং তারা দলের হুইপের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো ভোট দেননি। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের সদস্যপদ খারিজের কোনো হেতু ঘটেনি, এবং তারা ৭০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেননি। রুলিংয়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তৎকালীন বিরোধী দলের উপনেতা প্রফেসর ডা. বদরুদ্দৌজা চৌধুরী এবং চিফ হুইপ খন্দকার দেলোয়ার হোসেন রিট পিটিশন দাখিল করেন। বিষয়টি হাইকোর্ট হয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে গড়ায়।
আপিল বিভাগ স্পিকারের রুলিং অবৈধ ঘোষণা করে তাদের সদস্যপদ শূন্য ঘোষণার ইস্যুটি নির্বাচন কমিশনে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। নির্বাচন কমিশন আপিল বিভাগের অভিমতের আলোকে তাদের সদস্যপদ শূন্য ঘোষণা করে। আপিল বিভাগের এ সংক্রান্ত নির্দেশনা এবং অভিমতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের নতুন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, এটি সত্য যে, তারা দু’জন ৭০ অনুচ্ছেদের যে নির্দেশনা তা লঙ্ঘন করে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো ভোট দেননি এবং দল ত্যাগও করেননি। কিন্তু তারা নির্বাচকমণ্ডলীদের (ভোটার) সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তারা দু’জন বিএনপি’র আদর্শ, বিশ্বাস এবং ইশতেহার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে তারা বিপরীতধর্মী আদর্শ এবং ভিন্ন নির্বাচন ইশতেহার বাস্তবায়নের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এর ফলে তারা তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর বিশ্বাসকে ভঙ্গ করেছেন। এই রায়ের আলোকে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন স্বতন্ত্র সদস্যরা নির্দলীয়। তাদেরকে স্বতন্ত্র রূপে এবং স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখার জন্য নির্বাচকমণ্ডলীরা ভোট দিয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে নয়। বরং ভোটাররা স্বতন্ত্র সদস্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে পছন্দ করেন না বলেই তাদেরকে বেছে নিয়েছে। এখন যদি তিনি সেই দলে যোগদান করেন তা হবে তাকে যারা ভোট দিয়েছিল তাদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের শামিল। যা আপিল বিভাগের রায়ের যে চেতনা তার পরিপন্থি।
তারা অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারেন তবে এক্ষেত্রে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নতুবা এই সংসদের মেয়াদ শেষে।
সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
আইএ/ ১১ জানুয়ারি ২০২৪