স্থপতি রুকুন ও রাদিয়ার স্থাপত্যভুবন – আনন্দ আলো

স্থপতি রুকুন ও রাদিয়ার স্থাপত্যভুবন – আনন্দ আলো

স্থাপত্যশিল্পের মূলধারার কাজের সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে এবং আধুনিক সময়ের উপযোগী স্থাপত্যচর্চার অনুশীলন করে চলেছেন স্থপতি রুকুন উদ্দিন ভূঁইয়া ও স্থপতি রাদিয়া সুলতানা। তাদের স্থাপত্য ভাবনা কেবল নান্দনিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পরিবেশবান্ধব ও টেকসই নকশার মাধ্যমে মানুষের জন্য কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা গড়ে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য। স্থপতি রুকুন উদ্দিন ভূঁইয়া ২০০৮ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে দেশে ফেরেন। দেশের স্থাপত্যশিল্পে ইতিবাচক অবদান রাখার তাগিদ থেকে তিনি নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার পরিকল্পনা করেন। ২০১১ সালে স্থপতি রাদিয়া সুলতানাকে সঙ্গে নিয়ে সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেন এবং যৌথভাবে “মেট্রোপলিটন আর্কিটেক্টস” নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তারা দুজনেই এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা ও ইন্টেরিয়র করেছে।এই দম্পতি বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর সদস্য। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মানে আমি তে স্বামী – স্ত্রী দুজনকে নিয়েই প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক

বাংলাদেশের আবহাওয়া ,জলবায়ু, প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজের দিকে নজর দেন স্থপতি রাদিয়া সুলতানা ও রুকুন ভূঁইয়া। পেশার সাথে দায়বদ্ধ থেকে তাদের কাজটিকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে করতে ভালোবাসেন।
তিন বোনের মাঝে সবার বড় স্থপতি রাদিয়া সুলতানা। তার বেড়ে উঠা ঢাকার ধানমন্ডি ভুতেরগলির এক যৌথ পরিবারে। দাদা দাদি, চাচা, ফুপু কাজিনদের মাঝে বড় হওয়ার সুবাদে মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। রাদিয়ার বাবার নাম মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম খান। তিনি পেট্রোবাংলার যুগ্ম সচিব ছিলেম। মা সালমা খান গ্রিহিনী। ঢাকার আজিমপুরে অগ্রণী স্কুল ও কলেজ থেকে ২০০০ সালে এস এস সি পাশ করেন। ২০০২ সালে রাইফেলস পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এইচ এস পাশ করে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক এর স্থাপত্য বিভাগে। সেখান থেকেই ২০০৯ সালে ব্যাচেলর অফ আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন।
স্থপতি রুকুনের পৈতৃক গ্রামের বাড়ী নারায়ণগঞ্জ জেলা হলেও জন্ম এবং বেড়ে উঠা পিরোজপুরে।রুকুনের বাবার নাম এ কে এম রাহিম উদ্দিন ভুইয়া। তিনি ছিলেন একজন সনামধন্য চিকিৎসক। মা তানজিদা বেগম গৃহিনী। তিন ভাই বোনের মাঝে সবার ছোট রুকুন পিরোজপুরের সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে ভর্তি হোন আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যাচেলর অফ আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করার পর দেশে বেশ কিছু কাজ করেন। ২০০৭ সালে মাষ্টার্স করার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান আমেরিকাতে। সাভানা কলেজ অফ আর্ট এন্ড ডিজাইন থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে কিছুদিন কাজ করেন।নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশের মানুষের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে স্থপতি রুকুন ২০১০ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন।
গত ১৪ বছরে তারা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের ক্লায়েন্ট তালিকায় রয়েছে নাভানা রিয়েলস্টেট, রূপায়ন রিয়্লেস্টেট, কনকর্ড রিয়েলস্টেট, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, জেবিএস হোল্ডিংস, প্রিমিয়াম প্রপার্টিজ এবং সানমার রিয়েলস্টেট। এই প্রকল্পগুলোতে তারা আধুনিক স্থাপত্যশৈলী, টেকসই নকশা ও পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সৃজনশীলতা ও কার্যকারিতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন।


সম্পর্কিত

স্থপতি রুকুন উদ্দিন ভূঁইয়া ও স্থপতি রাদিয়া সুলতানা

স্থপতি রুকুন ও স্থপতি রাদিয়া তাদের স্থাপত্যকর্মে প্রযুক্তি, স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার এবং জলবায়ু-সহনশীল নকশার সমন্বয় করে টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে বাস্তব রূপ দিচ্ছেন। তাদের নেতৃত্বে মেট্রোপলিটন আর্কিটেক্টস আজ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পরিবেশবান্ধব ও টেকসই স্থাপত্য চর্চায় তরুণ স্থপতিদের জন্য এই স্থপতি দ্বয়ের পরামর্শ : বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই স্থাপত্য চর্চার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তরুণ স্থপতিদের জন্য এটি শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ও টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বও বটে। এই লক্ষ্য অর্জনে কিছু মৌলিক নীতিমালা ও কৌশল অনুসরণ করা জরুরি।
পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের দর্শন অনুধাবন করুন : পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য শুধু একটি নকশা পদ্ধতি নয়, এটি একটি দায়িত্বশীল স্থাপত্য দর্শন। এতে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় রেখে নকশা তৈরি করা হয়। তরুণ স্থপতিদের অবশ্যই এই দর্শনের গভীরতা অনুধাবন করতে হবে।
স্থানীয় উপকরণ ও নির্মাণ কৌশলকে প্রাধান্য দিন : বাংলাদেশের আবহাওয়া ও ভূগোল অনুযায়ী বাঁশ, পোড়ামাটি, মাটির ব্লক, নারকেলের ছোবড়ার বোর্ড, পুনর্ব্যবহৃত কাঠ ইত্যাদি স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করা পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে স্থাপনার স্থায়িত্ব বাড়াতে সাহায্য করে। তাই আন্তর্জাতিক প্রবণতার অন্ধ অনুকরণের চেয়ে স্থানীয় উপাদানের সঠিক ব্যবহার শেখা জরুরি।
পরিবেশবান্ধব বিল্ডিং ডিজাইনের নীতিমালা অনুসরণ করুন : পরিবেশবান্ধব বিল্ডিং ডিজাইনের নীতিগুলো অনুসরণ করলে বিদ্যুৎ ও কৃত্রিম শীতলীকরণ ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা কমে। উদাহরণ স্বরুপ।
দক্ষিণমুখী জানালা ব্যবহার করে শীতকালে পর্যাপ্ত সূর্যালোক প্রবেশ নিশ্চিত করা ও গরমকালে ছায়া প্রদান করা।
ছাদ বাগান বা সবুজ ছাদ তৈরি করে ভবনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা।
ক্রস ভেন্টিলেশন অর্থাৎ বাতাস ঢোকে বের হওয়ার পথ ডিজাইন করে প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের পথ তৈরি করা।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করুনঃ সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি ও ভূ-তাপীয় শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে জ্বালানি নির্ভরতা কমে আসবে। বিশেষ করে সৌর প্যানেল স্থাপন দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ খরচ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ভবন গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।
জল সংরক্ষণ ও বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনা করুনঃ বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়, যা সংরক্ষণ করা গেলে ভবিষ্যতে পানির ঘাটতি মোকাবিলা করা সহজ হবে। তরুণ স্থপতিদের রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং ও ভবনের চারপাশে জলাধার নির্মাণ এর মতো টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সবুজায়ন নিশ্চিত করুন : স্থাপনার নকশায় শহুরে বনায়ন, সবুজ ছাদ, উদ্যান পরিকল্পনা ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। ভবনের নকশা এমনভাবে করা উচিত, যাতে তা স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল টুল ব্যবহার করুন : স্থাপত্যচর্চায় BIM (Building Information Modeling), Energy Simulation, Climate Analysis ইত্যাদির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করলে সঠিক বিশ্লেষণ, খরচ বাঁচানো, এবং দক্ষ নির্মাণ নিশ্চিত করা সম্ভব।
সততা ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখুন : একজন স্থপতির কাজ শুধু নান্দনিক নকশা তৈরিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর দায়িত্ব হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও টেকসই নির্মাণ নিশ্চিত করা। তাই বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনার পাশাপাশি সামাজিক ও পরিবেশগত দায়বদ্ধতা মাথায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে মনোযোগ দিন : পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের নতুন নতুন কৌশল নিয়ে গবেষণা করুন, দেশ-বিদেশের সফল প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করুন, এবং স্থানীয় বাস্তবতায় কীভাবে সেগুলো প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করুন।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার প্রসার করুন : স্থপতিরা শুধু নকশাকার নন, তাঁরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে ক্লায়েন্ট, নির্মাণ শ্রমিক ও সাধারণ জনগণকে সচেতন করাও একজন স্থপতির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বাংলাদেশের নগরায়ন যদি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই স্থাপত্য নীতির উপর ভিত্তি করে হয়, তাহলে এটি কেবল উন্নয়নের প্রতীক হবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য দেশ গড়তে সাহায্য করবে। তরুণ স্থপতিদের এখনই টেকসই ও দায়িত্বশীল স্থাপত্যচর্চার দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

Scroll to Top