লোকজ সুরের মূর্ছনায় ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
মঙ্গলবার (২৯অক্টোবর) রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা’রে তুই মূল হারাবি’ শীর্ষক ৫৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে বাউল ও মরমী গানের অনুষ্ঠানে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন উপস্থিত অতিথিরা।
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, আমরা খুব সহজ না। বক্তারা বলেছেন আমরা আতঙ্কিত, আমরা কিছুটা ভিত কোথায় জানেনতো? ওই মূল না হারায়। আমরা এই মূল না হারায়। মানুষের মূল যেমন মানবতা, মানুষের মূল যেমন মানব প্রীতি, মানব ভালোবাসা, মানবতার উদাত্ত আহ্বান। এই বাংগালী জাতীর মূল তেমন আমাদের স্বাধীনতা। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি আপনাদের নিশ্চিই মনে আছে শেষ দুটো লাইন? মা তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। কখন মায়ের বদন মলিন হয় জিজ্ঞেস করুন নিজেকে। মাতৃভূমি মায়ের বদন এখন কতটা উজ্জ্বল।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন কোটা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছি এটা আমাদের বিজয়। আমরা বিজয় অর্জন করেছি। একটি সরকারের পরিবর্তে আরেকটি সরকার গঠিত হয়েছে। সরকার দেশ চালাচ্ছে। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে শুধু এতোটুকু বলি, একটি দেশের সরকারের পরিবর্তন সেই দেশের রাষ্ট্র পরিবর্তন না। রাষ্ট্র বাংলাদেশ স্মিথ সত্য। এই সত্য কারোর দানে পাওয়া না। এই সত্য বাঙ্গালি জাতির অর্জন। কোন আন্দোলনকে সরিয়ে দিয়ে আমরা মূলে স্থিতি স্থাপন করতে পারবো না। আমাদের মূল এই বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের অর্জন বাহাত্তরের সংবিধান। আজকে বলা হচ্ছে সংবিধান পরিবর্তনের কথা। কিভাবে একটি রাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তন করতে হয়, তা সংবিধানে স্পষ্ট করে লেখা আছে। দয়া করে সেটি পড়ুন এবং তারপরে আপনাদের সিদ্ধান্ত জানান। যে সংবিধানের ভিত্তিতে আপনারা শপথ গ্রহণ করেছেন তার থেকে বাইরে গেলে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে। সত্য বড় কঠিন। সত্য সত্যের মত সত্য। কোন ব্যত্যয় নয়। সেই ব্যত্যয় ৫৬ বছর বাংলাদেশ উদীচী গোষ্ঠী মানুষের মধ্যে জাগরণের গান গেয়ে মানবতা বোধকে উজ্জীবিত করছে এবং তা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাউল সাধক শফি মন্ডল বলেন, উদীচী বাংলাদেশের জন্মেরও আগের একটি প্রতিষ্ঠান। সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠান শিল্পগোষ্ঠী। সংগীত শুধু বিনোদন না, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হোক এই প্রত্যাশা জানাচ্ছি এবং উদীচীর আজকের এই ৫৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আয়োজনের মাধ্যমে আমরা আবারও আমাদের মনের বৈষম্যটা দূর করবো এই প্রত্যাশা করছি।
আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাউল সাধক শফি মন্ডল। পরে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা পর্ব। আলোচনায় অংশ নেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে জীবন দেয়া শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ-এর বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং মা, ফারহানা দিবা। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বাউল সাধক সাইদুর রহমান বয়াতি, উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা এবং ডা. লেলিন চৌধুরী।
আলোচনা পর্বের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এ পর্বের শুরুতেই সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচীর নৃত্যশিল্পীরা। এরপর সমবেত আবৃত্তি পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন উদীচীর বাচিক শিল্পীরা। পরে কয়েকটি বাউল ও লোক গান পরিবেশন করেন উদীচীর সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা। লালন সাঁই, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ দত্তের জনপ্রিয় কিছু গান পরিবেশন করেন তারা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন উদীচীর সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেন।
উদীচীর ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম ও হাবিবুল আলম, সূর্য লাল দাশ, পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল, কল্পনা খান, শাহিনুর আলামিন, অবিনাশ বাউল, আনান বাউল, ফতেহ আলী খান আকাশ প্রমূখ। এছাড়া, সমবেত পরিবেশনা উপস্থাপন করে উদীচী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ, বাড্ডা শাখা, গেন্ডারিয়া শাখা, ডেমরা শাখা ও রায়েরবাজার শাখার শিল্পীরা।
নিপীড়িত মানুষের গান গাইবার অঙ্গীকার নিয়ে, মানুষের মুক্তির জন্য, সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালানোর উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।