পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ একুশে। যুগ-যুগান্তরের অবদমিত বাঙালির রুদ্ধ জীবনে জাগৃতির প্রথম প্রহর একুশে। অমর একুশে বাঙালি চৈতন্যের বীজমন্ত্র: ভাষা ও সংস্কৃতির পরম্পরায় বৃহত্তর জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক রণযাত্রার ভ্যানগার্ড এবং ধর্মনিরপেক্ষ, উদার বাঙালির রাষ্ট্র বাংলাদেশের শাশ্বত পাটাতন।
একুশের ঐতিহাসিক দিনে, বায়ান্ন সালে, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার শিলালিপি লিখিত হয়েছিল রক্তাক্ত অক্ষরে। জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল হয়েছিল সমগ্র জাতিসত্তা। চরম আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়েছিল বাঙালির পরবর্তী ইতিহাস। একুশে সূচিত সেই উপাখ্যানের যবনিকা-পর্বের নাম বাংলাদেশ।
একুশে কেবল ইতিহাসের একটি রক্তবর্ণ তারিখ নয়। একটি শোণিত-শোভিত দিন। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের সমান্তরালে সতত সচল। নিরন্তর গতিময়। প্রাণবন্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ। জাতির এক অবিনাশী চেতনার মূলমন্ত্র।
একুশের চেতনার অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে। একুশের জন্ম হয়েছিল এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এবং একুশের গর্ভেই জন্ম নেয় বাঙালির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ক্রমধারা। একুশের কালপর্বে নিহিত জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমা। বাঙালির অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে মুক্ত করার প্রতীতি। কৃত্রিম, আরোপিত ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানের সঙ্কল্প।
তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা ৭ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলার বীর বাঙালি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধূমায়িত হতে থাকে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ, যা ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২-র মধ্যে ক্রমে জোরালো হয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীনতার রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করে। ফলে একুশের মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদের অদম্য স্পৃহা। যে কারণে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙে। পুলিশ গুলির বিরুদ্ধে বুক পেতে দেয়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না-জানা অনেকে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সারা পূর্ব বাংলা। পরদিন সারারাত জেগে শহীদদের স্মরণে গড়া হয় শহীদ মিনার। পুলিশ তা ভেঙে ফেললে আবারও গড়ে ওঠে শহীদ মিনার। এ শহীদ মিনার একুশের শোক, সংগ্রাম ও শপথের প্রতীক এবং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও জাতিচেতনামূলক আন্দোলনের চালিকাকেন্দ্র।
১৯৫২ সালের সেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় নবজন্ম আর সৃজিত হয় একুশের চেতনা, যা বাঙালির জাতীয় জীবনে আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। পরবর্তী প্রতিটি গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি। অধিকার-বঞ্চিত বাঙালির প্রথম সংগঠিত সংগ্রাম। বাঙালির আত্মসচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের সূচনা।
বাঙালি চৈতন্যের বীজমন্ত্র অমর একুশে বহুমাত্রিক ও বহুমুখী এবং ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন স্বরূপ। বাঙালির সংগ্রামে, অর্জনে, গৌরবে ও দীপ্তিতে ভাস্বর একুশে। একুশে সংকীর্ণতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মাচ্ছন্নতাকে পদানত করে উচ্চারণ করে আমরা বাঙালি। আলিঙ্গন করে বাঙালির জাতীয় ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ যাবতীয় নন্দনকলা ও ধ্রুপদী স্মারক। একুশে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতির দেশাত্মবোধক অভিমুখ।
১৯৫৩ সাল থেকে শহীদ দিবস উদযাপন করতে গিয়ে তখনকার প্রগতিশীল কর্মীরা কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্নপদে প্রভাতফেরি, শহীদের কবরে ও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রভাতফেরিতে সমবেত কণ্ঠে একুশের গান পরিবেশন, শহীদ মিনারে আলপনা আঁকা ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এসব কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ।
একুশে অম্লান, অক্ষয় ও অমলিন। বাঙালি চৈতন্যের বীজমন্ত্র অমর একুশে বাংলা ও বাঙালির চির সারথী। চির সমুন্নত একুশে প্রতিটি ফেব্রুয়ারিতে একুশের চেতনাবাহী পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আবাহন সঙ্গীত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে প্রতিটি বাঙালির চিত্তে, বাংলাদেশের কেন্দ্রে ও প্রান্তে প্রান্তে।