রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরকারের সতর্কবার্তা | চ্যানেল আই অনলাইন

রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরকারের সতর্কবার্তা | চ্যানেল আই অনলাইন

এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ

বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব একটি বড় সমস্যা। এই সঙ্কট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে ঢাকার বাইরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্কট সমাধানে সরকার কঠোর বার্তা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার বলছে ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসেবা বাড়ানোর বিষয়ে আমরা অগ্রাধিকার দেয়ার চেষ্টা করব, যাতে রোগীদের ঢাকায় আসতে না হয়। বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে দুই হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হবে।

সঙ্কটের শেষ নেই ঢাকার বাইরের বিভাগ, জেলা, উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে। একবার নষ্ট হলে আর মেরামত হয় না যন্ত্রপাতি। চালু হচ্ছে না আইসিইউ। জনবলের সংকটে খুঁড়িয়ে চলছে সেবা কার্যক্রম। জরুরি রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই রেফার্ড করা হয় ঢাকার হাসপাতালগুলোতে। প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ে রোগীরা। কমছে না ঢাকামুখী রোগীর স্রোত।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (কার্ডিওলজি) ডা. মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে দায়িত্বে অনুপস্থিতি ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে শুনানিতে ডাকা হয়েছে। এ ঘটনাটি শুধু ব্যক্তিগত একটি অনিয়মের প্রশ্ন নয়, বরং দেশের স্বাস্থ্যখাতের দীর্ঘদিনের একটি গুরুতর সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে-ঢাকার বাইরে কাজ করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনাগ্রহ ও অপ্রতুলতা।

রাজধানীমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএসডিসি) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের নিবন্ধিত প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার চিকিৎসকের বড় অংশই কর্মরত রাজধানী ঢাকা বা বড় শহরগুলোতে। অথচ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তীব্র ঘাটতি। বিশেষ করে কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, নেফ্রোলজি কিংবা ক্যান্সার চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশেষায়িত সেবায় ঢাকার বাইরে রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

এক গবেষণায় দেখা যায়, শহরে প্রতি ১০ হাজার জনে গড়ে ১৮.২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায়, অথচ গ্রামীণ এলাকায় এ সংখ্যা মাত্র ১.১। অর্থাৎ একই দেশে চিকিৎসা সেবার বৈষম্য ভয়াবহভাবে প্রকট।

স্বাস্থ্য সেবা খাতের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসকদের গড় অনুপস্থিতির হার ৫৮.৭ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ৫২ শতাংশ পদ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ২৫ শতাংশের বেশি পদ শূন্য।

অন্যদিকে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামীণ এলাকায় বাস করলেও তাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন মোট স্বাস্থ্যকর্মীর মাত্র ২০ শতাংশ। রাজধানী ও বড় শহরে ১৫ শতাংশ মানুষ থাকলেও সেখানে অবস্থান করছেন ৩৫ শতাংশ চিকিৎসক।

ফলে ঢাকার বাইরের রোগীদের বাধ্য হয়ে রাজধানীতে আসতে হয়। এতে সময়, খরচ ও শারীরিক কষ্ট বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা গুরুতর হওয়ার আগেই সঠিক বিশেষজ্ঞ সেবা পাওয়া সম্ভব হয় না।

অনাগ্রহের যেসব কারণ

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ঢাকার বাইরে যেতে অনীহা প্রকাশ করেন নানা কারণে-পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোর অভাব, উচ্চমানের গবেষণা বা পেশাগত উন্নতির সুযোগ সীমিত থাকা,রাজধানীতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ এবং সন্তানদের শিক্ষা ও পরিবার-সুবিধার বিষয়।

এই বাস্তবতায় রাজধানীর বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে শুধু ভবন দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সঠিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় সাধারণ মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের তাগিদ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, চিকিৎসক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা, উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, বেসরকারি খাতের সহযোগিতা ঢাকার বাইরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং রোগীদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। তবে রোগীদের বিদেশমুখী নির্ভরতা কমাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ জরুরি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান সম্প্রতি এক সভায় জানিয়েছেন ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসেবা বাড়ানোর বিষয়ে আমরা অগ্রাধিকার দেয়ার চেষ্টা করব, যাতে রোগীদের ঢাকায় আসতে না হয়।

সরকারের কড়া অবস্থান

ডা. মোস্তাফিজুর রহমানের ঘটনাটি সরকারের এক প্রকার সতর্কবার্তা। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ স্পষ্ট করে দিয়েছে-শুধু ঢাকায় বসে দায়িত্ব পালন নয়, বরং যে কর্মস্থলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেখানে উপস্থিত থেকে চিকিৎসা দিতে হবে। চিকিৎসকের দায়িত্বে গাফিলতি হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন দেশে ৮ হাজার ডাক্তারের সংকট রয়েছে, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে ২ হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

Scroll to Top