দিনটা ছিল ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। ঢাকার গভর্নর্স হাউসে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আব্দুল মোতালেব মালিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাই কমিশনারের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি জন কেলি।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
হঠাৎই আকাশে উড়ে এসেছিল ৪টি ভারতীয় বিমান – সবগুলোই মিগ টুয়েন্টি ওয়ান। ওই অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে এয়ার ভাইস মার্শাল হিসাবে অবসর নেয়া ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই।
তার লেখা বই, ‘থান্ডার ওভার ঢাকা’ বইতে তিনি লিখেছিলেন, “গভর্নর্স হাউসের ওপরে প্রতিটা বিমান দুবার করে চক্কর কেটে মোট ১২৮টি রকেট ফেলেছিলাম আমরা।”
“স্বাভাবিকভাবেই বেসামরিক সরকারের শিরদাঁড়া সেদিনই ভেঙ্গে গিয়েছিল। দুদিন পরে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি তার ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন,” ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই লিখেছিলেন।
কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগেই গঠিত হয় ভারতের ২৮ নম্বর ‘ফার্স্ট সুপারসনিকস’ স্কোয়াড্রন।
ওই স্কোয়াড্রন দিয়েই শুরু হয়েছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীতে মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের যাত্রা। রাশিয়ায় তৈরি ‘মিকোয়ান গুরেভিচ’ বা মিগ বিমান প্রথম ভারতে আসে ১৯৬৩ সালে।
ছয় দশকেরও বেশি সময় পরে এবার ভারতীয় বিমান বাহিনী চিরবিদায় জানাবে ‘মিগ’ বিমানকে। ভারতীয় গণমাধ্যম মঙ্গলবার জানিয়েছে যে বর্তমানে ২৩ নম্বর ‘প্যান্থার্স’ স্কোয়াড্রনের অন্তর্ভুক্ত ‘মিগ টুয়েন্টি ওয়ান’ শেষবারের মতো আকাশে উড়বে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর।
সোমবার (২২ জুলাই) বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জেএফ-৭ বিমানটি ঢাকায় ভেঙ্গে পড়েছে, সেটি এই মিগ টুয়েন্টি ওয়ানেরই প্রতিরূপ, মানে চীনে তৈরি অনুরূপ বিমান।
“সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। মিগ অনেক বছর আগেই তার কার্যকাল শেষ করেছে,”বলছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস সুজান। তিনি নিজে ১২-১৩ বছর মিগ টুয়েন্টি ওয়ান যুদ্ধ বিমান উড়িয়েছেন।

ঢাকার গভর্নর্স হাউসে বোমাবর্ষণ
ভারতের আসামের গুয়াহাটি থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে একটা ‘মিশনে’ গিয়েছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর অফিসার ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই। তার ডাকনাম ছিল ‘ভূপ’।
‘থান্ডার ওভার ঢাকায় তিনি লিখেছিলেন, “গ্রুপ ক্যাপ্টেন উলেন আমাদের অপারেশনস রুমে দৌড়ে এসে বললেন, ভূপ, একটা অত্যন্ত জটিল আর জরুরি কাজ এসেছে বিমানবাহিনীর সদর দফতর থেকে। ঢাকার সার্কিট হাউসে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছে, ওখানে হামলা চালাতে হবে ঠিক ১১টা ২০ মিনিটে।”
“আমি বললাম প্রথমত এখনই তো ১০ টা ৫৫ বাজে, ঢাকায় পৌঁছতে ২১ মিনিট লাগে আর তার ওপরে ঢাকায় এই সার্কিট হাউসটা কোথায়! উনি বললেন, জলদি করলে হয়ত সময়ের মধ্যে পৌঁছতে পারবে। আর, এই নাও ঢাকার একটা টুরিস্ট ম্যাপ – এই রাস্তার মোড়ে সার্কিট হাউস,” লিখেছিলেন ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই। তিনি তখন ‘ফার্স্ট সুপারসনিকস’ স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
চারটি মিগ টুয়েন্টি ওয়ান নিয়ে আকাশে ওড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একজন ফ্লাইট অপারেটর দৌড়তে দৌড়তে বিমানের কাছে আসেন।
ভূপেন্দ্র কুমার বিষ্ণোই লিখেছিলেন, “একজন ফ্লাইট কমান্ডার হাতে একটা কাগজ নিয়ে দৌড়ে এসে বলল, স্যার এটা আপনার জন্য। টার্গেট সার্কিট হাউস নয়, গভর্নমেন্ট হাউস, রিপিট গভর্নমেন্ট হাউজ। বেস্ট অব লাক অ্যান্ড গুড শুটিং।”
কোলে রাখা ওই পর্যটন মানচিত্র দেখেই তিনি চিহ্নিত করেন গভর্নর্স হাউস। এর আগে ডিসেম্বরের পাঁচ, সাত আর আট তারিখে ঢাকার তেজগাঁও আর কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে বার বার বোমা বর্ষণ করে এসেছে ‘ভূপ’এর নেতৃত্বে ‘মিগ’ বাহিনী।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হিসাবনিকেশ অনেকটাই পাল্টিয়ে দিয়েছিল মিগ টুয়েন্টি ওয়ান, এমনটা অনেক সমর-বিশেষজ্ঞই মনে করেন।
সেই কথা স্মরণ করে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের সময়ে ঢাকায় গিয়ে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ সেই সময়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১৯৭১-এর যুদ্ধে অংশ নেওয়া একটি মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের প্রতিমূর্তি।

যেভাবে মিগ এসেছিল ভারতে
ভারতের বিমান বাহিনীর ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে যে ১৯৬২ সালের অগাস্ট মাসে “এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যার ফলে পরবর্তী কয়েক দশকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর রূপ আর শক্তিতে নিবিড় বদল ঘটেছিল।”
সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত সরকার বিমান বাহিনীর জন্য যুদ্ধ বিমান আর ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম বহরটি এনেছিল।
সেই দফায় কেনা ১২টি মিগ টুয়েন্টি ওয়ানই ছিল ভারতের প্রথম “অ-পশ্চিমা” যুদ্ধ বিমান। ওড়ার জন্য তৈরি বিমান কেনা ছাড়াও ভারতেই যাতে এই যুদ্ধ বিমানগুলো উৎপাদন করা যায়, তার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তাও পেয়েছিল ভারত।
মিগ সিরিজের বিমানই ছিল ভারতের হাতে আসা প্রথম সুপারসনিক যুদ্ধ বিমান, অর্থাৎ যা শব্দের থেকেও দ্রুত উড়তে পারে।
বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হোক বা ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা ১৯৯৯ এর কার্গিল যুদ্ধ – সব সামরিক সংঘাতেই মিগ ব্যবহার করেছে ভারতীয় বিমান বাহিনী।
২০১৯ সালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যখন ভারত ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছিল, সেই সময়ে যে ভারতীয় বৈমানিক বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে পাকিস্তানে আটক হয়েছিলেন, সেই গ্রুপ ক্যাপ্টেন অভিনন্দন ভর্তমানও একটি মিগ টুয়েন্টি ওয়ান বাইসন বিমানই ওড়াচ্ছিলেন।
এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বশেষ সংঘাত, ভারত যার নাম দিয়েছিল অপারেশন সিন্দুর, সেখানেও মিগ বিমান স্কোয়াড্রনকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
গত ষাট বছরেরও বেশি সময়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী ৮৭০টি মিগ বিমান ব্যবহার করেছে।

প্রথম থেকেই দুর্ঘটনায় পড়ে মিগ
অন্তর্ভুক্তির সময়ে কারিগরি দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত ছিল মিগ, তবে প্রথম থেকেই দুর্ঘটনাতেও পড়েছে মিগ। প্রথম বছর, ১৯৬৩ সালেই দুটি মিগ ক্র্যাশ করেছিল।
সরকারি তথ্য সঙ্কলন করে ভারতের সংবাদপত্র ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ লিখেছে যে পাঁচশোরও বেশি মিগ টুয়েন্টি ওয়ান ভেঙ্গে পড়েছে, ১৭০ জন পাইলট সহ দুশোরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গত ১৫ বছরেই ২০টি মিগ বিমান ভেঙ্গে পড়েছে।
এত বেশি দুর্ঘটনায় পড়েছে বলেই মিগ টুয়েন্টি ওয়ানকে কখনও ‘কফিন-মেকার’ বা ‘উইডো-মেকার’ বলা হয়।
প্রথম যুগের মিগ টুয়েন্টি ওয়ানগুলোতে অনেক পরিমার্জন করা হয়েছে। সর্বশেষ যে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান আকাশে উড়তে সক্ষম, তার নাম মিগ টুয়েন্টি ওয়ান ‘বাইসন’।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস সুজান বলছিলেন, “মিগ টুয়েন্টি ওয়ানগুলিতে এত বছর ধরে অনেক পরিমার্জন করা হয়েছে। যদিও এটা ঘটনা যে সেগুলোও যথেষ্ট প্রাচীন হয়ে গেছে। মিগের বেশ কয়েকটা সীমাবদ্ধতাও আছে।”
“সব থেকে বড় সমস্যা হল মিগ-এ একটি মাত্র ইঞ্জিন থাকে। এছাড়াও আরেকটা সীমাবদ্ধতা হল এর পে লোড ক্যাপাসিটিও কম – জ্বালানি এবং অস্ত্র বহনের ক্ষমতা কম। আবার মিগের রেঞ্জও যেমন কম, তেমনই আকাশে ওড়ার সময়েই জ্বালানি ভরার ব্যবস্থাও নেই মিগের,” বলছিলেন সুজান।
তার কথায়, “যে কোনও আধুনিক বিমানবাহিনীতে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান এখন আর আদর্শ যুদ্ধবিমান নয়। যে বিমানে দ্বিতীয় ইঞ্জিনের সুবিধা নেই, আকাশে ওড়ার সময়ে জ্বালানি ভরা যায় না বা ভার বহনের ক্ষমতাও কম – সেরকম একটা যুদ্ধবিমান এখন আর চলে না। কার্যকাল অতিবাহিত হওয়ার পরেও যান্ত্রিক পরিমার্জন ঘটিয়ে এতদিন টেনেছে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান।
“এটা ঠিকই মিগ টুয়েন্টি ওয়ানে বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমাদের কমরেডরা নিহতও হয়েছেন। তবে দেখুন দুর্ঘটনা তো যে কোনও বিমানেই হতে পারে। মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের যদি আরও উন্নতমানের যন্ত্রাংশ থাকত, ভাল অটো-পাইলট ব্যবস্থা থাকত তাহলে হয়তো এত দুর্ঘটনা এড়ানো যেত,” বলছিলেন সুজান।

মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের বিকল্প
মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের বিকল্প হিসাবে ভারতীয় বিমান বাহিনী নিয়ে এসেছে লাইট কম্ব্যাট এয়ারক্র্যাফ্ট ‘তেজস’।
অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন সুজান বলছিলেন মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের বদলে লাইট কম্ব্যাট এয়ারক্র্যাফ্ট ‘তেজস’ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। তবে ‘তেজস’ পরিকল্পনা রূপায়িত হতে বহু বছর দেরি হয়েছে।
“আমরা যখন বিমান বাহিনীতে যোগ দিলাম সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়, আমাদের বলা হয়েছিল যে আমরা সম্ভবত পাশ করার আগেই তেজস ওড়ানোর প্রশিক্ষণ পেয়ে যাব। তবে এখনও যথেষ্ট তেজস নেই বাহিনীতে,” বলছিলেন সুজান।
ভারতের সামরিক বাহিনীগুলির খবরাখবর দেয়, এমন একটি পোর্টাল ‘ডিফেন্স ওয়াচ’ জানাচ্ছে ‘তেজস’ তৈরি করে যে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড, কথা আছে যে তারা ২০২৭-২৮ সালের মধ্যে ৮৩টি বিমান দেবে।
ওই সাইটেই লেখা হয়েছে যে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের মধ্যে ১৮টি বিমান দেয়ার কথা।
“তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিই-র ইঞ্জিন পাওয়া নিয়ে বড় সমস্যা রয়েছে। এর ফলে তেজসের পরিকল্পনা অনেক বছর পিছিয়ে রয়েছে।”
“আসলে মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের বিকল্প যে লাগবে, তার জন্য অনেক আগে পরিকল্পনা করা দরকার ছিল। এটা তো বিমানবাহিনীর প্রধান নিজেও স্বীকার করেছেন। সেজন্যই এত বছর ধরে মিগ বিমান দিয়েই চালাতে হচ্ছে,” বলছিলেন সুজান।
তবে আর নয়।
সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে মিগ টুয়েন্টি ওয়ান।
সুজানের কথায়, “আমাদের সতীর্থরা প্রায় সকলেই মিগ টুয়েন্টি ওয়ান উড়িয়েই কেরিয়ার শুরু করেছি, কারণ তখনও সেগুলোই ছিল বিমান বাহিনীর মূল যুদ্ধ বিমানবহর। মিগের বহরে সাধারণত আমরা পাঁচ-ছয় বছর থাকতাম। এরপরে আমাদের উন্নততর বিমান. যেমন মিরাজ টু থাউজ্যান্ড বা মিগ টুয়েন্টি নাইন ইত্যাদিতে পাঠানো হত।”
“আমি নিজে প্রায় ১২-১৩ বছর মিগ টুয়েন্টি ওয়ান উড়িয়েছি, তারপরে আমাকে দেয়া হয়েছিল সুকোই থার্টি। এখন মিগ টুয়েন্টি ওয়ানের বিদায় বেলায় এসে মনটা ভারাক্রান্ত তো হচ্ছেই।”
“কোনও বিমানবহর যখন বাহিনী থেকে অবসর নেয়, তার সঙ্গে জড়িত থাকে অনেক সুখস্মৃতি। তবে বাস্তবের দিক থেকে বিচার করলে মিগ টুয়েন্টি ওয়ানকে অবশেষে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্তটা সঠিক,” বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস সুজান।