মানুষ জহির রায়হান নয় তাঁর কাজের আকর্ষণে প্রেমে পড়েছিলাম- কোহিনুর আখতার সুচন্দা – আনন্দ আলো

মানুষ জহির রায়হান নয় তাঁর কাজের আকর্ষণে প্রেমে পড়েছিলাম- কোহিনুর আখতার সুচন্দা – আনন্দ আলো

চিত্র নায়িকা কোহিনুর আখতার সুচন্দা। চলচ্চিত্রে যার ৫৮ বছরের পথচলা। সম্প্রতি চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার অভিনয় জীবনের অনেক গুরুত্বপুন তথ্য তুলে ধরেছেন। সঙ্গে ছিলেন বিশেষ্ট সাংবাদিক, উপস্থাপক আব্দুর রহমান। তারই চুম্বক অংশ আনন্দ আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল -সম্পাদক

আব্দুর রহমান:বার একুশে বইমেলায় প্রতি বছরের মতো অনেক নতুন বই প্রকাশ হয়েছে। হাজার হাজার নতুন বইয়ের ভীড়ে চিত্র নায়িকা সুচন্দার লেখা একটি বই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এটি একজন চলচ্চিত্র শিল্পীর প্রথম আত্মজীবনী প্রথম বই। বইটির নাম- ‘আজও ভুলিনি’। আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা মূলক প্রকাশনা। প্রিয় অভিনেত্রী সুচন্দা। আপনি একটি বই লিখেছেন। বেশ মোটাতাজা বই। প্রচুর ছবি, প্রচুর কাহিনী আছে এই বইয়ে। কী করে এতটা সময় পেলেন? কেনই বা এই বইটি লিখলেন?
কোহিনুর আখতার সুচন্দা: বেশ কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছিল এই যে এতটা বছর পার হলো চলচ্চিত্রে, প্রায় ৫৮ বছর পার করলাম। সবকিছু মিলিয়ে মন কেন যেন উতলা হয়ে উঠছিল। আমার উচিৎ একটা কিছু করা। অভিনয় জীবনের পাশাপাশি ছোটবেলার কথাগুলোও বলা দরকার। আমার এই বইয়ে ছোটবেলার কথাও আছে। যখন থেকে জ্ঞান, বুদ্ধি হয়েছে, স্কুল জীবন শুরু করেছি। যখন থেকে পড়াশুনা শুরু করেছি, ভাই বোন, মা—বাবা আত্মীয় স্বজনকে ঘিরে যে স্মৃতি গুলো জমা হয়ে গেছে তা বলা দরকার। বিশেষ করে আমি যে অঙ্গনের মানুষ অর্থাৎ চলচ্চিত্রের মানুষজন নিয়েই তো আমার জীবন পার হলো তাদের নিয়েও কিছু করা উচিৎ। যাদের সঙ্গে জীবন পার করেছি তাদের নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি জমা হয়ে আছে। ইচ্ছে করলেই তো আমি তা লিখতে পারি। এই ভাবনা থেকেই বইটি লিখতে শুরু করি।
আব্দুর রহমান: আপনার নাম ছিল চাটনী…
কোহিনুর আখতার সুচন্দা: এটা আমার দাদার দেওয়া নাম। আমার পারিবারিক নাম কোহিনুর আখতার। চলচ্চিত্রে আসার পর আমার নাম হয়ে যায় সুচন্দা। এই নামটা দিয়েছিলেন আমাদের গুণী পরিচালক সুভাষ দত্ত। যার সিনেমার মাধ্যমে আমি চলচ্চিত্রের আঙিনায় পা ফেলেছি। ছবির নাম ‘কাগজের’ নৌকা। ১৯৬৬ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল।

সম্পর্কিত

আব্দুর রহমান: এই যে ৫৮ বছর আপনার পথ পরিক্রমা। এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য গুরুত্বপুর্ন ঘটনা। শুরুর গল্পটা কেমন?
কোহিনুর আখতার সুচন্দা: আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় করবো বা করতে পারব এই রকম কোনো চিন্তা ভাবনা কখনই ছিল না। আমার স্বপড়ব ছিল লেখাপড়া করব, ব্যারিস্টার হবো। কলেজে পড়ছি। আমাদের পরিবার রক্ষণশীল ছিল। কিন্তু শিক্ষিত পরিবার। বলতে পারেন অভিনয়ে আসার পর আমাদের জেনারেশনই একটু কম শিক্ষিত। এনিয়ে আমার বাবার একটা অভিমান ছিল। কারণ চলচ্চিত্রে আসার পর এতই ব্যস্ত হয়ে যাই যে, পড়াশুনার প্রতি নজর দিতে পারিনি। আমার যেমন বি এ পরীক্ষার প্রিপারেশন চলছিল। কিন্তু সিনেমায় আমার পর বিএ পরীক্ষা দিতে পারিনি। হঠাৎ করেই আমার চলচ্চিত্রে আগমন। আমরা ৬ ভাই বোন। তিন ভাই, তিন বোন। এক ভাই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, আরেকজন পাইলট, আরেকজন আমেরিকায় চাকরি করছে। তিন বোন—ববিতা, চম্পা আর সুচন্দা। আমার যখন চলচ্চিত্রে অভিনয় করার অফার আসে তখন আমি জানতামই না চলচ্চিত্রে কী করে অভিনয় করতে হয়? আমি কোনোদিন মঞ্চে নাটকও করিনি।
আব্দুর রহমান: শকুন্তলায় অভিনয় করেছিলেন?
কোহিনুর আখতার সুচন্দা: ওটা একটা নৃত্যনাট্য ছিল। নৃত্যনাট্যে অভিনয় করেছি। একটু আধটু গান গাইতাম। রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার অনেক প্রিয়। স্কুল, কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। অনেক পুরস্কারও পেয়েছি।
আব্দুর রহমান: সিনেমায় অভিনয়ের অফার এলো। আপনাকে সুভাষ দত্তের বাসায় যেতে বলা হল। আপনি তার বাসায় গেলেন। সুভাষ দত্তের সঙ্গে দেখা হল। এরপর আপনার বাসায় একটা পারিবারিক সভা বসেছিল…
কোহিনুর আখতার সুচন্দা: হ্যা একটি পারিবারিক সভা বসেছিল। আমি সুভাষ দত্তের বাসায় গেলাম। ফিরেও এলাম। কিন্তু বাবা—মা তো এব্যাপারে কিছু বলছেন না। আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় করবো কী করবো না? কেউ কিছু বলছে না। আমি শুধু অপেক্ষায় আছি। যাই হোক অপেক্ষার মধ্যেই কয়েকটা দিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে পারবে? আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম- পারব।


আব্দুর রহমান: আপনার অভিনীত দ্বিতীয় ছবি একজন অনেক বড় মাপের পরিচালক বানাবেন। জহির রায়হান। তার কালজয়ী সিনেমা ‘বেহুলায়’ আপনার ডাক পড়লো। এই ছবিতে আরেকটি ঘটনা ঘটলো। বেহুলার মাধ্যমে আমাদের সিনেমায় নায়ক হিসেবে আবিভূর্ত হলেন নায়ক রাজ রাজ্জাক। বেহুলার গল্পটি শুনতে চাই।
কোহিনুর আখতার সুচন্দা: আমার ধারনা জহির রায়হান বুঝতে পেরেছিলেন তার নতুন ছবিতে আমার মতো একজন নবীণ অভিনেত্রীকে প্রয়োজন। সেই ভাবনা থেকেই তিনি বেহুলায় আমাকে ‘কাস্ট’ করেছিলেন। তখন আমরা ঢাকায় গেন্ডারিয়া এলাকা থাকি। জহির রায়হান আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তার কয়েকজন সহকারীও সঙ্গে ছিলেন। তিনি যখন আমাদের বাসায় এসে ড্রয়িং রুমে বসলেন আমি তখন অন্যঘরে ছিলাম। মা এসে বললেন, জাহির রায়হান এসেছেন, তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। সত্যি কথা বলতে কী আমি জহির রায়হান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। তিনি অনেক নামকরা চিত্র পরিচালক, বহু পুরস্কার পেয়েছেন, এসব আমার মাথায়ই নাই। কারণ আমি তার কোনো সিনেমা দেখিনি। তার কাছে যাবার আগে আমি ধরেই নিয়েছিলাম এত বড় পরিচালক। এত নাম ডাক। নিশ্চয়ই অনেক বয়স হবে তার। কিন্তু তার সামনে গিয়ে আমি তো হতবাক। এতবড় একজন লেখক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, অথচ বয়স অনেক কম। মনে হল ভার্সিটিতে পড়া একটা ইয়াং ছেলে। আমি অনেকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। জাহির রায়হানের হাতে ছিল একটি চাবির রিং। তিনি বিশেষ স্টাইলে চাবির রিং ঘোরাছিলেন। এই ছিল প্রম দৃষ্টি। তারপর যাই হোক উনি ছবিতে অভিনয়ের অফার দিলেন।

Scroll to Top