মশার কামড়ে ভাইরাস: ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ চিকুনগুনিয়া | চ্যানেল আই অনলাইন

মশার কামড়ে ভাইরাস: ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ চিকুনগুনিয়া | চ্যানেল আই অনলাইন

বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মশাবাহিত ভাইরাস চিকুনগুনিয়া। মশার কামড় থেকে ছড়িয়ে পড়া এই রোগে চলতি বছর দুই লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—এই ভাইরাস কতটা ভয়ংকর? আমরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছি? আর বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রস্তুত তো এই নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায়?

চিকুনগুনিয়া কী?

চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা প্রধানত এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশাগুলো ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার ও জিকা ভাইরাসও বহন করে। চিকুনগুনিয়া শব্দটি এসেছে আফ্রিকার কিমাকোন্ডে ভাষা থেকে, যার অর্থ মোচড়ানো বা বেঁকে যাওয়া— যা রোগীদের দীর্ঘস্থায়ী জয়েন্ট ব্যথাকে বোঝায়। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানো মশা সুস্থ কাউকে কামড়ালে তার শরীরেও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ঘটে।

ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে

ইউরোপীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ইসিডিসি) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৬টি দেশে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ লা রিইউনিয়ন, মায়োত্তে ও মরিশাসে বড় আকারে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। শুধুমাত্র লা রিইউনিয়নে মে ২০২৫ পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৫০০-এর বেশি রোগী ও ১২টি মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে। ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা এবং পেরু – এই দেশগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে।

ভারতীয় শহর মুম্বাই, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, সোমালিয়া ও কেনিয়া, এবং ইউরোপের ফ্রান্সসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্রান্সে মে মাসের পর থেকে ৮০০টির বেশি বহিরাগত কেস ধরা পড়েছে।

চীনের গুয়াংডং প্রদেশের ফোশান শহরে জুনের শেষ থেকে শুরু হওয়া প্রাদুর্ভাবে ৭ হাজার জনের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এটি ২০০৮ সালে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর চীনে সবচেয়ে বড় চিকুনগুনিয়া প্রাদুর্ভাব। সংক্রমণ ইতিমধ্যেই প্রদেশের অন্তত ১২টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে।

পদক্ষেপ

  • চীনের সরকার দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ড্রোন দিয়ে মশার প্রজননের স্থান চিহ্নিত করা হচ্ছে।হাতি মশা বা এলিফ্যান্ট মসকিউটো ছাড়া হয়েছে, যাদের লার্ভা ভাইরাস-বহনকারী ছোট মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। বাসিন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলতে। ফুলদানি, কফি মেশিন, খালি বোতলেও পানি জমে থাকলে ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্দেশ না মানলে ১০ হাজার ইউয়ান পর্যন্ত জরিমানা এবং গুরুতর ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলাও হতে পারে। আক্রান্তদের কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ডে নিয়ে রাখা হচ্ছে, যেখানে মশার জাল ও স্ক্রিনে ঘেরা পরিবেশে চিকিৎসা চলছে।
  • লা রিইউনিয়ন ও মায়োত্তে উন্নত পর্যবেক্ষণ, মশা নিয়ন্ত্রণ ও টিকাদান কার্যক্রম চালু করেছে।
  • স্পেন ফ্রান্স সীমান্তের হেনদায়ে কেস শনাক্তের পর প্রতিরোধমূলক প্রটোকল চালু করেছে। নাগরিকদের মসকিউটো এলার্ট অ্যাপে রিপোর্ট করার উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।

উপসর্গ ও চিকিৎসা

রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, র‍্যাশ, মাথাব্যথা এবং তীব্র জয়েন্ট ব্যথা। এই রোগে নবজাতক, প্রবীণ এবং হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। যদিও বেশিরভাগ রোগী এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন, অনেকের ব্যথা মাসের পর মাস বা এমনকি বছরের পর বছর থাকতে পারে। বর্তমানে এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই এবং মৃত্যুহার সাধারণত খুব কম।

প্রতিরোধ

  • চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
  • ফুলহাতা জামা ও লম্বা প্যান্ট পরা
  •  মশা প্রতিরোধী লোশন ব্যবহার
  •  বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ
  •  মশারি বা বদ্ধ ঘরে থাকা
  • চিকুনগুনিয়ার নির্দিষ্ট ওষুধ না থাকলেও পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পানি পান এবং ব্যথানাশক ওষুধ উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে।
  • তবে, ডেঙ্গু সন্দেহ থাকলে এনএসএআইডি জাতীয় ব্যথানাশক এড়িয়ে চলা জরুরি, কারণ এতে রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ে।

বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনসহ আক্রান্ত দেশগুলো মশা নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যক্তিগত সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপই হতে পারে এই ভাইরাস থেকে রক্ষার সর্বোত্তম উপায়।

সূত্র: আল জাজিরা

Scroll to Top