সুমিত্র নাথ
‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে’ যে দেবী এসেছিলেন পৃথিবীতে, তিনি স্বর্গে পাড়ি জমিয়েছেন দুই বছর হলো। ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ স্বর্গ হয়তো আরও উজ্জ্বল এখন। কিন্তু ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’ পান্থ পাখিদের মত মনটা বারবার পথ ভুলে চলে যাচ্ছে ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’। ‘চঞ্চল মন আনমনা’ হয়ে উঠছে বারবার। এতদিন পার হয়ে গেল তবুও কিছুতেই যেন মন বসছে না একদম! সুরের সরস্বতীর প্রস্থানে যেন অনেক কিছুই হয়ে আছে অস্থির।
‘না যেও না, রজনী এখনও বাকি’ শুনেও যেন ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’।
ছোটবেলায় তখনও নাম জানতাম না লতা মঙ্গেশকরের। কিন্তু ততদিনে রেডিওতে ‘প্রেম একবারই এসেছিল’ কিংবা ‘আমি যে কে তোমার’ শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছি।
‘হাম কো হামি সে চুরা লো’ অন্যতম পছন্দের গান। ‘তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম’ তখন খুব হিট। হিন্দির কিছুই না বুঝেও কেমন মধুর এই সুরে আকৃষ্ট ছিলাম তখনও।
‘ইয়ে কাহা আ গায়ে হাম’, ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’, ‘এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়’, ‘জো ওয়াদা কিয়া’ স্কুল জীবনে শুনে বোঝার চেষ্টা করতাম।
‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোই’ ছিল প্রিয় গানগুলোর ওপরের সারিতে। এখনও আছে তেমনই। ‘লাগ যা গালে’ শুনলে মনে হয় একটা নদীর কিনারে চাঁদের আলোয় সমুদ্রের দারুণ অনুভূতিটা পাচ্ছি।
এমন অসংখ্য দারুণ অনুভূতি দেওয়া ৩০ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন সুরের সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর। যাকে পুরো ভারতবর্ষ লতাজি নামে ডাকেন, স্মরণ করেন। এই একটা নাম শুনলে যেন এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুণী মানুষটাও বিনয়ের সঙ্গে নুয়ে পড়েন। আহা! শ্রদ্ধা, ভালোবাসা!
হবেই বা না কেন! লতাজির সুরের মূর্ছণায় হৃদয়ে নাড়া দেয় নি, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। একটা কথা বলতেই হচ্ছে, কত সৌভাগ্যবান হলেই এই দেবীর জীবনকালেই এসেছিলাম। ভাবছিলাম, সুরের সরস্বতীর আবির্ভাবের আগে পৃথিবীতে এলে দেবীর সুরে হারিয়ে যাওয়া হতোই না!
পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে লতা মঙ্গেশকর ছিলেন সবার বড়। মনের দিকেও ছিলেন দেবীর মতো বিশাল। সারাক্ষণ হাসি মুখে কথা বলতেন। গানের মত তার কথাতেও যেন সুরের জাদু আছে। কথা শুনলেই মনে হয়, যেন মর্ত্যের দেবী শান্তির সুবাস ছড়াচ্ছেন। সেই সুবাসে চারদিক করছে মৌ মৌ।
সুরের সরস্বতী যে ত্রিশ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন, তা শুধুমাত্র বাংলা, হিন্দি কিংবা মারাঠি ভাষায় নয়। ৩৬টিরও বেশি ভাষায় গান গেয়েছেন সুরের দেবী। যার মধ্যে বাংলা গান আছে ১৮৫টিরও বেশি। প্রথম বাংলা গান গেয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে। গানের পাশাপাশি প্রযোজনা করেছেন ৪টি সিনেমাও।
এতো সব সৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে স্বর্গে চলে গিয়েচিলেন মর্ত্যের দেবী। কিন্তু এখানে এখনও তার জন্য হাহাকার চলছে। লতা মঙ্গেশকরের চলে যাওয়ায় ২ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হয়েছিল ভারতে। কলকাতায় টানা পনেরদিন তার গান বাজবে এমন ঘোষণাও দিয়েছিলেন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী। তারপর পার হয়ে গেছে আরও দুই বছর। সুরের দেবীর ভক্তদের এই শোক তো কেবল দুই বছরের নয়, শ্রোতা ভক্তদের জন্য চিরকালের।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই