ভ্যানচালকের মেয়ে সোনালী এখন জাতীয় দলের তারকা

ভ্যানচালকের মেয়ে সোনালী এখন জাতীয় দলের তারকা

পঞ্চগড় : অভাবের কঠিন বাস্তবতাকে জয় করে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলেছেন পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে ফেরদৌসি আক্তার সোনালী। নিজের অদম্য ইচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমে তিনি এখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক। তার এই জয়যাত্রা শুধু নিজের নয়, বরং প্রমাণ করে যে স্বপ্ন আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো বাধাকে অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব।

সোনালী সম্প্রতি সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে অংশ নিয়ে লাওস থেকে দেশে ফিরেছেন। ফিরেই তিনি ছুটে যান নিজের গ্রাম— পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের বনগ্রামে।

দীর্ঘদিন পর মেয়েকে দেখে আবেগাপ্লুত হন বাবা ফারুক ইসলাম, যিনি একজন ভ্যানচালক। মেয়ের সাফল্যে গর্বিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি ভ্যান চালাই, আমার মেয়ে বিমানে চড়ে দেশের হয়ে খেলতে যায়। এই আনন্দ ভাষায় বোঝানো যায় না।’

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেই সোনালী বড় হয়েছেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। তার বাবা ফারুক ইসলাম ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান, আর মা মেরিনা বেগম গৃহিণী। ৭ শতক ভিটেমাটি ছাড়া তাদের আর কোনো সম্পদ নেই। সেই ভিটেমাটি থেকেই দেশের ফুটবলে এক নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছেন গোলরক্ষক সোনালী।

বাবা-মা’র আর্থিক সামর্থ্য ছিল না মেয়েকে খেলার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করার, কিন্তু তবুও সোনালী থেমে থাকেননি। খালি পায়ে, কখনো খেয়ে না খেয়ে, কখনো প্রতিবেশীদের কটূক্তি উপেক্ষা করে তিনি চালিয়ে গেছেন অনুশীলন।

সোনালীর মা মেরিনা বেগম বলেন, ‘এমন অনেক দিন গেছে যখন টাকার অভাবে মেয়েকে অনুশীলনে পাঠাতে পারিনি। কিন্তু সে কখনো হাল ছাড়েনি। ফুটবলই ছিল ওর ধ্যানজ্ঞান। অনেক সময় নিষেধ করলেও শুনতো না। আজ সেই মেয়েই যখন জাতীয় দলে খেলছে, তখন এই আনন্দ কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা হয় না।’

গইচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই ফেরদৌসি আক্তার সোনালীর ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়। সেখানেই তিনি বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন। এরপর হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে দারুণ নৈপুণ্য দেখান।

এই সময়েই পঞ্চগড়ের স্বনামধন্য টুকু ফুটবল একাডেমির নজরে আসেন সোনালী। একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, ‘সোনালী দারুণ সম্ভাবনাময় একজন মেয়ে। একাডেমিতে অনুশীলন করতে করতেই বুঝেছিলাম সে অনেক দূর যাবে। আজ সে জাতীয় দলে খেলছে—এটা আমাদের একাডেমির জন্যও এক বড় গর্বের বিষয়।”

২০২৩ সালে সোনালীর ফুটবল প্রতিভার স্বীকৃতি আসে, যখন তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। বর্তমানে তিনি নবম শ্রেণিতে পড়ছেন এবং বিকেএসপিতে গোলরক্ষক হিসেবে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

সোনালী বলেন, ‘বিকেএসপিতে থাকা অবস্থায়ই জাতীয় দলে ডাক পাই। এরপর সিনিয়র দলের সঙ্গে জর্ডানে খেলে আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। এরপর সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপেও শিরোপা জিতি। সর্বশেষ লাওসে এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে খেলে আমরা রানার্সআপ হয়েছি।’

একটি বিশেষ দিক হলো, জাতীয় নারী ফুটবল দলের আরেক গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগমও সোনালীর পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা। পঞ্চগড়ের হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে তার বাড়ি। তিনিও টুকু ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন করেছেন। ফলে একই ইউনিয়ন থেকে একসঙ্গে দুই গোলরক্ষকের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা পুরো এলাকার জন্যই এক বিশাল গর্বের বিষয়।

হাড়িভাসা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, ‘সোনালী আমাদের গর্ব। সমাজের নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সে আজ এই অবস্থানে এসেছে। আমরা চাই, প্রশাসন তার পাশে থাকুক, যাতে সে আরও ভালো করতে পারে। তার পরিবারের জন্যও সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।’

সোনালীর এই পথচলা প্রমাণ করে যে, স্বপ্ন বড় হলে, মনের জোর থাকলে আর সঠিক সময়ে সঠিক সহযোগিতা পেলে গ্রামের মেয়েও জাতীয় দলে পৌঁছাতে পারে। সোনালীর এই সাফল্য শুধু তার একার নয়, বরং এটি দেশের নারী ক্রীড়াঙ্গনের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা।

Scroll to Top