বিধ্বস্ত গাজায় বেঁচে থাকার প্রেরণা ফুটবল

বিধ্বস্ত গাজায় বেঁচে থাকার প্রেরণা ফুটবল

চোখ ফোটার পর অন্য শিশুরা শোনে বাহারি খেলনার আওয়াজ, ঝলমলে বাতিতে ভরে ওঠে তাদের নতুন ঘর। বিশ্বের অন্য দশটি শিশুর মতো অবশ্য গাজার শিশুরা সেই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। চোখ মেলায় পর থেকেই তাদের কানে আসে গুলির আওয়াজ, চোখ ঝলসে যায় বোমার বিস্ফোরণে। গত ছয় মাস ধরে চলা ইসরাইলী আগ্রাসনে গাজা যেন এখন ধ্বংসস্তূপ। প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকাই যেখানে বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে খেলাধুলা তো নেহায়েতই আদিখ্যেতা। তবে শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও গাজার শিশুরা বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি পাচ্ছে এই ফুটবলেই। মেসি, নেইমার, রোনালদোদের খেলা আগের মতো দেখতে না পারলেও তরুণ প্রজন্মকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তারাই।

২০২৩ এর অক্টোবরের ৭ তারিখ থেকে চলমান ফিলিস্তিন-ইসরাইলী সংঘাতে বিধ্বস্ত পুরো ফিলিস্তিন। বিশেষ করে চিরচেনা সেই গাজা উপত্যকাকে চেনা যেন বড় দায়! মাইলের পর মাইল যেন বিশাল এক ধংসস্তুপ। হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, বাস্তুহারা হয়েছেন লাখো অসহায় ফিলিস্তিনি। প্রাণভয়ে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে দূর দূরান্তের আশ্রয়কেন্দ্রে পাড়ি জমিয়েছেন প্রায় সবাই। বাড়িঘর বলতে অবশ্য সেখানে রয়েছে শুধুই ইট-কংক্রিটের ধংসস্তুপ। এক বেলা শুষ্ক রুটির জন্য যেখানে হাহাকার, খেলাধুলার কথা কি কারো মাথায় আসতে পারে?

হ্যাঁ পারে। যেমনটা আসে ২০ বছর বয়সী মেডিক্যাল শিক্ষার্থী হামজা এল ওটির। রিয়াল মাদ্রিদের পাড় ভক্ত হামজা রাত জেগে দেখতেন প্রিয় দলের খেলা। গত অক্টোবরের শেষে ঘর ছাড়ার পর প্রিয় দলের খেলাও আর দেখতে পারেন না হামজা, ‘আমার বাড়ি এখন ধংসস্তুপ। ফুটবলের সব স্মৃতি সেখানে চাপা পড়ে গেছে। বাড়ি থাকলে আমি রাত জেগে পপকর্ণ, কোলা নিয়ে খেলা দেখতে বসতাম। এখন বন্ধুদের কাছে হাইলাইটস দেখেই মন ভরাতে হচ্ছে।’

নেই পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, নেই দ্রুতগতির নিরবিচ্ছিন ইন্টারনেট; টিভি, মোবাইল চালানো তাই বেশ কঠিন। এমন অবস্থার মাঝেও নিজেদের প্রিয় ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ম্যাচ মিস করেন না ১৫ বছর বয়সী আবু নামির ও তার মা। টিভি, মোবাইল না থাকলে রেডিওতে শোনেন আল নাসরের ম্যাচে ফলাফল, ‘শেষবার আমরা রোনালদোর ম্যাচ দেখতে পেরেছিলাম ১ ফেব্রুয়ারি। খেলা চলার মাঝে বেশিরভাগ সময়ই ইন্টারনেট চলে যায় অথবা বিদ্যুৎ শেষ হয়ে যায়। আমরা তখন রেডিওতেই খবর শুনি। এভাবেই আমরা জেনেছি যে ফিলিস্তিন এশিয়া কাপে ভালো করেছে।’

দেশের এমন অবস্থার মাঝেই এবারের এশিয়ান কাপে নিজের ইতিহাসের সেরা পারফরম্যান্স করেছে ফিলিস্তিন। প্রথমবারের মতো শেষ ১৬তে যাওয়া ফিলিস্তিনের জন্য গর্বিত সবাই। নামির জানিয়েছে, দেশের কেউই তাদের সাফল্য আশা করেনি, ‘সত্যি বলতে ফিলিস্তিন এতদূর যাবে আমরা কেউই ভাবিনি। আমরা তাদের নিয়ে গর্বিত।’

রিয়াল-বার্সার এল ক্লাসিকোর উত্তাপ পৃথিবীর অন্য দশটি দেশের মতো ছুঁয়ে যা ফিলিস্তিনকেও। ২৩ বছর বয়সী বাসেল জাওয়াদ যেমন বার্সা সমর্থক, মিস করেন না একটি এল ক্লাসিকোও। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর আগের মতো আর ম্যাচ দেখা হয় না তার। ফুটবল তার মনকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে কিছুটা প্রশান্তি দেয় বলেই জানিয়েছেন, ‘ফুটবল আমাকে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বোমার আঘাত থেকে কিছুটা মুক্তি দেয়। আমি আমার কাজিনদের সাথে ফুটবল দেখতাম। তারা রিয়ালের সমর্থক ছিল। ম্যাচকে ঘিরে খুবই আনন্দ করতাম সবাই। কিন্তু এই যুদ্ধে তারা প্রাণ হারিয়েছে।’

হামজা, নামির, জাওয়াদদের গল্পটা যেন হাজারো ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরদের। ধ্বংসস্তুপের মাঝে তারা স্বপ্ন দেখেন রোনালদো-মেসিদের নিয়ে। কোথাও কুড়িয়ে পাওয়া বর্ণহীন বল নিয়ে আশ্রয় শিবিরের নোংরা অলি গলিতেই মেতে ওঠেন ফুটবলে। কেউ গোল পেয়ে উদযাপন করেন রোনালদোর ‘সিউউ’ স্টাইলে, কেউবা মেসির মতো আকাশে হাত উঁচিয়ে। তাদের বিশ্বাস, একদিন থেমে যাবে সব যুদ্ধ, ঘরে ফিরে আবারও ফুটবলে মাতবে পুরো গাজাবাসী।

তাদের সেই স্বপ্ন কি কখনো বাস্তবে রূপ নেবে?

তথ্যসূত্র- আল জাজিরা

The post বিধ্বস্ত গাজায় বেঁচে থাকার প্রেরণা ফুটবল appeared first on Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment.

Scroll to Top