বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ভূখণ্ড হয়ে জন্ম নেওয়ার ৫৩ বছরের দ্বারপ্রান্তে। এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জনকল্যাণে উঠা সকল দাবির সর্বাগ্রে ছিল যে দলটি সেটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
স্বাধীনতার এই সময়কালে এককদল হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় যে দলটি ক্ষমতায় সেটিও আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে, ঠিক তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া একটি দেশের পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে যিনি তুলে নেন তিনি আওয়ামী লীগের সে সময়ের সভাপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দায়িত্ব নেবার মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে স্বাধীন দেশের জনগণের জন্য একটি সংবিধান উপহার দেন। যে সংবিধানে দেশের মালিক হিসেবে সর্বাগ্রে তুলে ধরেন এই দেশের সাত কোটি মানুষকে।
শুধু তাই নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠনে নেন নানাবিধ উদ্যোগ। কারণ এখন আর আন্দোলন নয়, যে স্বপ্নের তরে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন ও ৩ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে এই দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে হবে। আর তাই তো বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর মনোযোগী হন সে সোনার বাংলা গড়ার দিকে। কিন্তু কোথাকে শুরু করবেন? সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন।
তখন সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত একটি জনপদের নাম বাংলাদেশ। দেশে তখন অর্থনীতি বলতে কিছু নেই। নয় মাসের যুদ্ধে শুধু ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দেয়নি, তার সাথে সাথে পাকিস্তানিরা একটি দেওলিয়া ভূখণ্ড রেখে যায়। যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয় রাস্তা ঘাট, স্কুল/কলেজগুলোর অবস্থাও ভাল না। দেশে শিল্প উৎপাদন বলতে কিছু নেই, সংকট সেই শিল্প পরিচালনার কাঁচামাল। তার উপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা ভয়াবহ।
এমনই এক পরিস্থিতিতে যখন দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার বেশি প্রয়োজন ঠিক তখন ডান-বাম মিলে সেই পরিবেশকে সমূলে বিনষ্ট করে। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে দেখা দেয় খরা, যে কারণে ব্যাহত হয় ফসল উৎপাদন। ফলে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। সে সময় প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও অপূর্ণতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তার ক্যারেশমেটিক নেতৃত্বে, বিদেশি সাহায্যের উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাফল্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন।
একদিকে অর্থনৈতিকভাবে শূন্য দেশ, আন্তর্জাতিক চাপ, মানুষের মহাপ্রত্যাশা এমন বহুমুখী সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু অনেক প্রতিষ্ঠান, আইন গড়ে ছিলেন, যার সুফল আমরা আজও ভোগ করছি। সে সময়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, ত্রাণ কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ, ভারতীয় বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি, শিক্ষা কমিশন গঠন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাসহ নানা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
তবে ষড়যন্ত্রকারীরা স্বাধীনতার পরেও থেমে থাকেনি। যার চরম পরিণতি আমরা দেখি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। সেদিন বাঙালি জাতির স্রষ্টাকে হত্যা করে কিছু বিপথগামী সৈন্য। দেশি-বিদেশি সে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় এই দেশেরও কিছু মীর জাফররা। থেমে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল। তারপর কেটে যায় ২১ বছর। নানা উত্থান পতনের ভিতর দিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। তবে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দায়িত্ব নেন দলের, দলকে পুনর্গঠনে কাজ করেন দিন-রাত। তবে বৃথা যায়নি পরিশ্রম, বাংলার মানুষ আবারও তাদের রায় দেয় আওয়ামী লীগের পক্ষে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জোটগতভাবে সরকার গঠন করে দলটি।
সরকার গঠন করেই আওয়ামী লীগ ইনডেমনিটির মত কালো আইন বাতিল করে, শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার কার্যক্রম। দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া দেশে নিষিদ্ধ ছিল তার নাম নেয়া। সে অপবাদের গ্লানি থেকেও মুক্ত হয় দেশ। উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন দেশকে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ভারতের সঙ্গে করেন ৩০ বছর মেয়াদি পানি বণ্টন চুক্তি। এছাড়াও ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য করেন ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি। একই সময়ে হয় উদ্বোধন করেন যমুনা সেতু, ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন পদ্মা সেতুরও। তবে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। আবারও দীর্ঘ হয় আওয়ামী লীগের অপেক্ষার প্রহর।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারও শুরু হয় আওয়ামী লীগের নবযাত্রার। সেই নবযাত্রায় দলটির সামনে ছিল ‘রূপকল্প-২০২১’। এই সময়ে প্রথমেই যে দু’টি সাফল্য পায় দলটি, তার একটি ভারতের সংসদ সীমান্ত নির্ধারণ ও ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুমোদনের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান। আরেকটি সমুদ্রসীমা নির্ধারণ। যার মধ্য দিয়ে ৭০ বছরের ও বেশি সময় ধরে চলা বিরোধের মীমাংসা হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর আরও দু’টি নির্বাচনে জয়ী হয় দলটি। এর মধ্য দিয়ে টানা ১৫ বছর ধরে সংসদে আছে দলটি। এই সময়ে আন্তর্জাতিক প্রায় সকল মানদণ্ডে এগিয়েছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগসহ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয় সারা বিশ্বে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশে অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি, মাতৃত্ব এবং শিশু স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, গৃহায়ন প্রকল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়। এছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, ক্রীড়া, পরিবেশ, কৃষি, খাদ্য, টেলিযোগাযোগ, সংস্কৃতি, সামাজিক নিরাপত্তা, মানবসম্পদ উন্নয়ন এমন কোনো খাত নেই যে খাতে অগ্রগতি সাধিত হয়নি।
টানা ১৫ বছরের সরকার পরিচালনায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। এই সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে যেমন পদ্মা সেতুর মত মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছে ঠিক তেমন দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন আলো। বাস্তবায়ন করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশের টানেল। এমনই নানা অবকাঠামোগত ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দলটি।
এনিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বার্তা২৪.কম কে বলেন, উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধিতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ, বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, পরিবর্তনের বাংলাদেশ, সমৃদ্ধির বাংলাদেশ, সক্ষমতার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষের জন্য যদি আন্তরিক হয়, দেশের মানুষের মঙ্গল চায়, দেশের সমৃদ্ধি চায়, নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে সেটা করা সম্ভব এটা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সে কাজটি করে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।
দেশের স্বার্থে, মানুষের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন সে বাংলাদেশ নির্মাণ করাই বিজয় দিবসে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার বলেও জানান তিনি।