৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পর্বের অন্যতম ছাত্রনেতা দীপা সেন। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) নেত্রী। ৬৯-এ ছাত্রদের ১১ দফার অন্যতম সিগনেটরি ছিলেন তিনি। সম্প্রতি চানেল আই অনলাইনের সাথে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কথা বলেন।
সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী দীপা সেনের বয়স এখন আশি ছুঁই ছুঁই। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পর্বে তিনি সরাসরি অংশ নেন। সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্য আর আদম্য সাহস ছিল তাঁর বুকে। তাঁর পিতাও ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা। তাঁর বাবার নাম সুধাংশু বিমল দত্ত। উনি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন চট্টগ্রাম থেকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। বৃটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে অনুশীলন গ্রুপে ছিলেন। স্বাধীকারের লড়াই করতে গিয়ে তিনি দীর্ঘদিন জেলও খাটেন। দীপা সেনের মাও কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। বাবা ও মায়ের আদর্শের পথ ধরে তিনিও কমিউনিস্ট ধারার সাথে যুক্ত হন।
সেই স্মৃতি ধরে দীপা সেন বললেন, ‘৬২ সালে মেট্রিক পাশ করে আমি ঢাকাতে এসে ইডেন কলেজে ভর্তি হই। এর আগেই ছাত্র ইউনিয়নের সংস্পর্শে আসি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কমরেড ফরহাদ আহমেদের সংস্পর্শে আমি। তখন আমি এবং বর্তমান সংসদ সদস্য লুৎফুন নেছা খান বিউটি আমরা একসাথে ইডেন কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তুলি। ওই সময় মতিয়া আপার সাথে দেখা হয়। আমি ইডেনের হোস্টেলেই থাকতাম। ইডেন কলেজ তখন বকশীবাজারে। আর হোস্টেল ছিল আজিমপুরে। হোস্টেলে আমিই ছিলাম প্রথম হিন্দু মেয়ে। হোস্টেলে প্রতিটি মেয়ের সাথেই ছিল আন্তরিক সম্পর্ক। ইডেন থেকে পাশ করার পর আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু প্রচণ্ড অসুস্থ হওয়ার কারণে ভর্তি হতে পারিনি। পরে চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। এই ডিপার্টমেন্ট তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল।
‘প্রসঙ্গত বলে রাখি আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে প্রকাশ্যে রাজনীতি ছিল না। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের তখন জাগৃতি এবং ইউএসপিপি নামে পরিচিত ছিল। আমি মেনন গ্রুপের সাথেই সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হই। আমরা চীনপন্থীই ছিলাম। ৬৫-৬৭ পর্যন্ত চট্টগ্রামেই থাকি। এরপর আবার আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হই। ৬৭-এ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে থাকনে মোস্তফা জামাল হায়দার। সাধারণ সম্পাদক তখন মাহবুবউল্লাহ। আমি ছিলাম সহ-সাধারণ সম্পাদক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি দেখেছি মাওলানা ভাসানীকে একাই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তিনটি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বেশি সক্রিয় ছিল। এ ছাড়া তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরীর নেতৃত্বে ডাকসু ছিল। এনএসএফের একটি অংশ এসেছিল আন্দোলনে। ১১ দফা প্রণীত হওয়ার পর ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ এখানে স্বাক্ষর করেন। ওই সময় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে আমি সিগনেটরি হিসেবে ছিলাম। আমার মনে আছে এসময় নানান ঘটনা ঘটতে থাকে। একসময় সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভাঙার। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) রাজি হয় না। এমন প্রেক্ষিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ভেঙে যাওয়ারও উপক্রম হয়।’
‘উনসত্তরের উত্তাল লড়াই-এ সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ, স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে অংশগ্রহণ করে। তবে ১৭ জানুয়ারি ছিল একটা টার্নিং পয়েন্ট। এদিন ছাত্রছাত্রীরা বিরাট মিছিল করে। আমরা টিয়ারগ্যাস সেল আক্রমণের শিকার হই। আমি ঐ সময় ছিলাম ডাকসুর কমনরুম সেক্রেটারিও। রোকেয়া হল থেকে আমি ডাকসু মেম্বারও নির্বাচিত হই। কবি রুবি রহমানও তখন ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হন। রুবি রহমান ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদকও ছিলেন। সেদিন তিনদিক থেকে আক্রমণ করে পুলিশ। আমাদের সবার হাতে ছিল লাঠি। একসময় আমরা গুলিস্তানের দিকে অবস্থান করি। আমি আহতও হই। আন্দোলন টানা চলতে থাকে। এরপর ২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হন।’
সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী বলেন, ‘৬৯-এর র গণঅভ্যুত্থান নিয়ে বলবো —এই আন্দোলনে ছাত্র, শ্রমিক, জনতার সবার অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শহরের সাধারণ মানুষেরও ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। আসাদের মৃত্যুর পর এই আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আর আমাদের সব দাবিই ছিল জনগণের পক্ষে। সেসময় সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। সবার মাঝে এমন ধারণাও হয়েছিল ছাত্ররাই এখন দেশ চালাবে।’
সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী দীপা সেন সবশেষে বলেন, ‘একটা গণজাগরণ হলো, একটা গণঅভ্যুত্থান হলো। কিন্তু বামপন্থীরা যে চিন্তা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সেই প্রত্যাশা পূরণ করেনি। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। স্বাধীনতার পর মনে হয়েছিল এতদিন পশ্চিম পাকিস্তানের বুর্জোয়াদের দ্বারা দেশ শোষিত হচ্ছিলো আর স্বাধীনতার পর সেখানে স্থলাভিষিক্ত হলো —পূর্ব পাকিস্তানের বুর্জোয়রা।’