বাংলাদেশের দুই স্থপতি জিতলেন বিশ্বসেরা স্থাপনার পুরস্কার – আনন্দ আলো

বাংলাদেশের দুই স্থপতি জিতলেন বিশ্বসেরা স্থাপনার পুরস্কার – আনন্দ আলো

ভারতের স্বনামধন্য জে কে সিমেন্ট লিমিটেড আয়োজিত আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতার এবারের আসরের বিদেশি বিভাগে বর্ষসেরা স্থপতি হয়েছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ। এছাড়া এই বিভাগের কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন আরেক খ্যাতিমান স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার। তিনি নকশাবিদ আর্কিটেক্টস এর প্রধান স্থপতি। নারায়নগঞ্জের খানপুরে অবস্থিত ‘রিয়াজ লফট’ এবং রাজধানী শুক্রাবাদে অবস্থিত ‘নন্দিনী হোটেল’ এর জন্য তাঁরা এই পুরস্কার পান। আনন্দ আলোরর ঈদ সংখ্যায় শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে স্বনামধন্য এই দুই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

স্থাপত্য অঙ্গনের অসাধারণ প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে গত ৩৪ বছর ধরে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে ভারতের স্বনামধন্য সিমেন্ট কোম্পানি জে কে সিমেন্ট লিমিটেড। এই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ সংস্করণে প্রায় ২৫০টি প্রকল্পের মধ্য থেকে বিদেশি বিভাগে বর্ষসেরা স্থপতি হয়েছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ। এই বিভাগের কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন স্বনামধন্য স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার। এর আগে নারায়নগঞ্জের আমান মসজিদের জন্য ৩১ তম জে কে সিমেন্ট আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডস পেয়েছিলেন তিনি। ভারত ভাড়াও এবার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ, ভুটান, কেনিয়া, মালদ্বীপ, মরিশাস, নেপাল, সেশেলেস, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া ও উগান্ডার স্থপতিরা।
সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়ে বিশ্বসেরা স্থাপনার পুরস্কার জিতে নেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান দুই স্থপতি। আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার পুরস্কার জয় লাভ করেন স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ। তাঁর প্রকল্পটির নাম রিয়াজ লফট। ঢাকার অদূরে নারায়নগঞ্জের খানপুরে রয়েছে শিশুদের একটি খেলার মাঠ। শিশুরা এই মাঠে খেলাধুলা করে। এই প্রকল্পটির মালিক রিয়াজ। তাঁর শৈশবের বড় একটা অংশ কেটেছে এই মাঠেই। মাঠের পাশেই তাঁর নানি বাড়ি। এখনো সময় পেলেই ছুটে যেতে চান শৈশবের সেই নানি বাড়িতে। মাঠের পাশের রাস্তার ওপারেই নানি বাড়ির সাথেই রয়েছে তাঁর আড়াই কাঠার ছোট্ট একটা প্লট। সেখানে নিজের জন্য এমন একটি বাড়ি বানাতে চেয়েছিলেন রিয়াজ, যে বাড়ি থেকে সহজেই নজরে পড়বে ছোটবেলার সেই মাঠটি।
মাত্র ১৬ ফুট বাই ৬৫ ফুটের বাড়িটিত্ইে রিয়াজের সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ। বাড়িটির ডিজাইনের মুখ্য বিষয়ই ছিল অপর পাশের মাঠটি। বাড়িটির ছাদে এমন ভাবে একটি মাচা রাখা হয়েছে, যেখানে বসে সহজেই খেলার মাঠটিতে শিশুদের আনা গোনায় চোখ রাখা যায়। আকাশ খোলা টেরাসটি যেন মাঠটি দেখার জন্যই তৈরি করা একটি মাচা।
‘রিয়াজ লফট’ প্রকল্পটি নিয়ে স্বনামধন্য স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ বলেন, ছোট্ট এই জায়গায় এই প্রকল্প আমরা পুরোপুরি রাজউকের নিয়ম মেনে করেছি। বাড়টি আসলে মাঠকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। যেহেতু এই বাড়ি নিয়মিত ব্যবহারের জন্য নয়, মূলত অবকাশ যাপনের জন্য। আমরা বাড়িটি থেকে মাঠের দিকে একটি ইনফিনিটি ভিউ তৈরি করতে চেয়েছি।
হোটেল নন্দিনী স্থাপনার জন্য জে কে সিমেন্ট কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য স্থপতি নকশাবিদ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার।
‘হোটেল নন্দিনী’ পুরোনো ভবনটি বলা হয় ঢাকার শুক্রাবাদের ব্যস্ততম সড়ক মিরপুর রোডের প্রথম ছয় তলা স্থাপনা। যার এক পাশে আবার পেছনে ১২টি প্লটে যাওয়ার রাস্তা রাখা হয়েছে। ভবনটি কখনো ছিল হোটেল, কখনো অফিস, কখনো স্কুল, ইউনিভার্সিটির অংশ। আবার কখনো ছিল ব্যাংক। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই অনেকবারই ভবনটির নকশায় বদল হয়েছে। সেই ভবনের প্রথম দুই তলায় ফ্ল্যাগশিপ স্টোর, পরের তিন তলায় ১৩টি করে ৩৯টি হোটেল রুম, নিচে হোটেল লবি ও কফিশপ, মাঠ ছাদে কিচেন, রুফটপ রেস্তোরা এ রকম একটি প্রকল্পের দায়িত্ব পান স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার। স্ট্রাকচারাল বিষয়গুলো একই রেখে পুরো ভবনটির লে-আউট সংস্কার করেন তিনি।
অত:পর হোটেল নন্দিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পুরোনো ভবনটি। ভবনটি সজানোর সময় মৃৎশিল্প ও হস্তশিল্পের নানা উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। একদিকে এখানে যেমন আছে সবুজের সমারোহ, তেমনি আছে আগুন লাগলে বের হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
হোটেল নন্দিনী’ স্থপনাটি সম্পর্কে স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার বলেন, ভবনের প্রতিটি ফ্লোর ভিন্ন ভিন্নভাবে ইম্প্রোভাইজ করা হয়েছিল। সেখান থেকে ভবনের ভেতরে বেশি হাত না দিয়ে আমরা বাইরে একটি নাইট ওয়েট স্ক্রিন নিয়ে করতে চেয়েছি। এই সড়কে মূলত কাঁচের তৈরি ভবনই বেশি দেখা যায়। আমরা দেখি, কাঁচ ব্যবহার করে ভবনকে গরম করে আবার তা ঠান্ডা করা হয়। সে জন্য এখানে আমরা লুভরের ব্যবহারে যাই। সাধারনত সবাই উল্লখ এবং অনুভূমিক ভাবে ব্যবহার করে থাকে। আমরা এখানে লুভরগুলোকে ভবনের সম্মুখ অভিমুখী করে বসাই। এতে পশ্চিমের রোদ থেকে বেশ কিছুটা ছায়া পাওয়া যায়। প্রচন্ড গরমে ভবনটিকে শীতল রাখবে। এভাবেই অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও এই ব্যস্ত সড়কে একটি পরিবেশ বান্ধব স্থাপনা হয়ে ওঠে হোটেল নন্দিনী।
ভবনটির সজ্জায় প্রাধান্য পেয়েছে মৃৎশিল্প ও হস্তশিল্পের নানা উপাদান। ভবনটিকে দৃষ্টিনন্দন একটি স্থাপনাতেও পরিণত করেছে। একটি পুরোনো অপরিকল্পিত স্থাপনাকে নতুন ভাবে রূপ দেওয়ার অনন্য এক উদাহরণ এই প্রকল্প।
দর্ঘি দুই দশকের বেশি সময় ধরে আধুনিক স্থাপত্যশিল্পে সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন নিজের স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখে। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০০ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘নকশাবিদ আর্কিটেক্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে রংপুরে রবাটসন গঞ্জের কারুপন্য লিমিটেডের কারখানা, ঢাকার বিজয় সরনীতে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে বৈদ্যের বাজার এলাকায় আমান মসজিদ, মিরপুর-২ এ কিডনী ফাউন্ডেশন হসপিটাল।
এছাড়াও নতুন কাজের মধ্যে রয়েছে সাভারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং বিপিএটিসি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আর্মড ফোর্স ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মিউজিয়াম প্রকল্প, কুড়িগ্রামে নর্থবেঙ্গল মিউজিয়াম ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর তার কাজের অন্যতম নিদর্শন। প্রবীন স্থপতি ‘আলী ইমাম’কে সঙ্গে নিয়ে বায়েজিদ বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের কাজ করেছেন। স্থপতি বায়েজিদ দেশের জন্য প্রযুক্তি পরিবেশ বান্ধব নকশা প্রণয়ন করে যাচ্ছেন। স্থাপনার কাজে বায়োজিদ মাহবুব খন্দকারের রয়েছে অসম্ভব সাফল্য। প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিয়ে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে তার সাফল্যের ঝুড়িতে জমা হয়েছে সেরা কর্মের স্বীকৃতি।
উল্লেখযোগ্য অ্যাওয়ার্ড গুলোর মধ্যে রয়েছে- স্থাপত্যের জন্য এশিয়ার মর্যাদাপুর্ণ পুরস্কার ‘আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার ২০২৩ এ দুটি স্বর্ণ পদক পায় কারুপণ্য রংপুর লিমটেড’। সামাজিক দায়বদ্ধ স্থাপত্য প্রকল্পের জন্য বিশেষ পুরস্কার হিসেবে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের গ্রিন ফিল্ড ফ্যাক্টরি প্রকল্পের স্বীকৃতি স্বরূপ স্বর্ণ পদক জিতেন বায়োজিদ। তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতেও বিজয়ী হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। বায়েজিদ মাহবুব ২০২২ সালে ইউআইএ ২০৩০ পুরস্কার পেয়েছিলেন। নারায়নগঞ্জের জে কে সিমেন্ট আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডস পেয়েছিলেন তিনি। হোটেল নন্দিনীর জন্য এবার তিনি জে কে সিমেন্ট কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড পেলেন।

সম্পর্কিত



Scroll to Top