বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া ও বাজি নিষিদ্ধ করতে নানা পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, টেক জায়ান্ট ‘মেটা’র বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে হাজারও বাজির বিজ্ঞাপন বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে। ২০২৫ সালেও সেই ধারা অব্যাহত আছে।
ডিসমিসল্যাবের তথ্য বলছে, এই অবৈধ প্রচারণায় এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)-জেনারেটেড ভিডিও ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপনে এআই-চরিত্র ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আদালতের মতো দৃশ্যের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের প্রতারিত করা হচ্ছে। এসব ব্যবহার করা হয়, যাতে ব্যবহারকারীদের বিশ্বাস অর্জন করা যায়।
সম্প্রতি এক সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব ক্লিকবেইট বিজ্ঞাপন মূলত দেশের দরিদ্র ও বেকার তরুণদের লক্ষ্য করে বানানো, যারা সহজে লাভের আশায় এসব সাইটে বিনিয়োগ করে। এসব বিজ্ঞাপন দেশের আইন ও মেটার নীতিমালা— দুটোই লঙ্ঘন করছে।
প্রচারণার স্রোত: একদিনেই হাজারও জুয়ার বিজ্ঞাপন!
শুধু ১২ আগস্টেই মেটা প্ল্যাটফর্মে ৪,১৬১টি জুয়া ও বাজির বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে, জানিয়েছে ডিসমিসল্যাব। ১০টি সাধারণ কীওয়ার্ড (যেমন ‘krikiya’, ‘mostbet’, ‘jeeta’, ‘jitaace’, ‘Babu88’, ‘casino’, ‘betting’, ‘lucky 7’, ‘baji’, ‘FB77’) দিয়ে এই বিজ্ঞাপনগুলো শনাক্ত করা হয়, যা ২২৫টি পেজ থেকে এসেছে।
সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন চালিয়েছে ‘Luck BD’ ও ‘FB77Super lucky’— একদিনেই যথাক্রমে ১ আহার ৩৭৯ ও ১ হাজার ২৬৫টি।
অনেক পেজের পরিচালকেরা অবস্থান করছেন বিদেশে—বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ভারত, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। তবে অন্তত ৬২টি পেজ বাংলাদেশের ভেতর থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপন দেশের আইন এবং মেটার নীতিমালা লঙ্ঘন করেই চলছে।

প্রচলিত ভিডিওর বদলে জুয়ার বিজ্ঞাপন এখন এআইতে
ডিসমিসল্যাবের এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন আর তারকাদের বিকৃত ভিডিও নয় বরং এআই-জেনারেটেড ভিডিও দিয়ে চলছে জুয়ার বিজ্ঞাপন। ফেসবুকে প্রতিদিন ছড়ানো এসব ভিডিওতে দেখা যায়– বাজার, আদালত, হাসপাতাল, এমনকি রাজনৈতিক মিছিলের ভেতরেও চলছে FB77-সহ বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপের প্রচার।
এক ভিডিওতে দেখা যায়– এক রিকশাচালক আধা কেজি মাংস কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। পাশেই এক ব্যক্তি বলে উঠছেন, ‘FB77 আমার জীবন বদলে দিয়েছে।’ আরেকটিতে হাসপাতালের মর্মস্পর্শী দৃশ্য, যেখানে অ্যাপটি খেলে জিতে অপারেশনের খরচ জোগাড় হচ্ছে।
আরেক ভিডিওতে দেখা যায়– আদালতে একজন বিচারক FB77 ব্যবহারকারীকে ‘ইনকাম জিনিয়াস’ বলে ঘোষণা করছেন। এমনকি রাজনৈতিক দলের মিছিলে নেতারা FB77কে দারিদ্র্য মুক্তির উপায় হিসেবে তুলে ধরছেন!
আরেকটি এআই-জেনারেটেড ভিডিওতে দেখা যায়– পেছনে এনসিপির ব্যানার আর সামনে হাসনাত আবদুল্লাহর আদলে একজন বক্তা বলছেন, ‘FB77 কোনো গেম নয়, আয় করার প্ল্যাটফর্ম।’ জনতার ভিড় থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে– ‘ভোটের আগে ইনকাম করো, FB77-এ জয়েন করো।’
লঙ্ঘিত হচ্ছে মেটার নীতিমালা
মেটার নীতিমালার অনুযায়ী, এমন দেশগুলোতে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না, যেখানে জুয়া আইনত নিষিদ্ধ। যেসব দেশে জুয়া বৈধ, সেখানেও বিজ্ঞাপনদাতাকে মেটা থেকে পূর্বানুমতি নিতে হয়।
জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখানোর অনুমতি নেই, এমন কয়েকটি দেশের একটি তালিকা করেছে মেটা। বাংলাদেশও সেই নিষিদ্ধ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। মেটার নীতিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ১৮ বছরের নিচে কোনো ব্যবহারকারীকে লক্ষ্য করে এসব বিজ্ঞাপন চালানো যাবে না।
তবে এসব পরিষ্কার নিয়ম থাকার পরও মেটা একদিকে যেমন এ ধরনের বিজ্ঞাপন শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি কার্যকর পদক্ষেপও নিতে সক্ষম হচ্ছে না।

বাংলাদেশের আইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, জুয়া প্রতিরোধের দায়িত্ব সরাসরি রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। ১৮৬৭ সালের দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, প্রকাশ্য স্থানে জুয়া খেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২০২২ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট একটি রুল জারি করে জানতে চায়– কেন টেলিভিশন, নিউজ পোর্টাল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় খেলার বিরতিতে বা সংবাদ পরিবেশনের সময় অবৈধ অনলাইন বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধ না করাকে অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং কেন তাৎক্ষণিকভাবে এসব বিজ্ঞাপন সরাতে নির্দেশনা দেয়া হবে না।
সবশেষে, ২০২৫ সালের মে মাসে জারি করা সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশে জুয়া ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কেউ যদি কোনো পোর্টাল, অ্যাপ বা ডিভাইসের মাধ্যমে সাইবার স্পেসে জুয়া তৈরি, পরিচালনা, অংশগ্রহণ, সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করে কিংবা এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ বা প্রচার করে, তবে তা একটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য হবে।
/এএম