দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পে নান্দনিক স্থাপনার নকশা করে যাচ্ছেন স্থপতি তানজিম হাসান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি জার্মানির বাওহাউস ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে পড়াশোনা করেন। তাঁর রয়েছে “ডি ডাব্লিউ জি” নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ যাবৎ তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা করেছেন। স্থাপত্য চর্চা ছাড়াও তিনি পেইন্টিং-এ পারদর্শী। তাঁর দুটি একক চিত্র প্রদর্শনী সুধী সমাজের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে এই স্থপতি কে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন-মোহাম্মদ তারেক
ডিজাইনের ক্ষেত্রে আমি লক্ষ্য রাখি ভবনটি স্থাপত্যিক বিন্যাস, স্পেস কোয়ালিটি, দৃষ্টিনন্দন এবং অবশ্যই এর ব্যবহার উপযোগিতা। ক্লায়েন্টের চাহিদা জানার পর নিজস্ব স্থাপত্য স্টাইলে সেটির রূপান্তর করি। কথাগুলো বললেন স্থপতি তানজিম হাসান। ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০১০ সালে নিজে গড়ে তোলেন ডি ডব্লিউ জি নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
এই স্থপতির উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে আগারগাঁও এ স্ত্রী নাহিদ ফারজানা সঙ্গে যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বিজয় স্মরণীতে সামরিক জাদুঘরের সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী গ্যালারির ডিজাইন, টাঙ্গাইল কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কে অবস্থিত বিজেআইটির সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বগুড়ায় বিশেষায়িত শিশুদের স্কুল প্রয়াস, সাত মসজিদ রোডে নাভানার মেহের স্কাই লার্ক, সিলেটে এসো কনসালট্যান্ট এর সাথে যৌথভাবে আরডিআরএস এর ট্রেনিং ক্যাম্পাস, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির ডরমিটরি এবং বর্ধিত অংশের কাজ, চট্টগ্রামের অবস্থিত কোরিয়ান ইপিজেডের ইয়ং ওয়ান কর্পোরেশনের ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস (চলমান), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল (চলমান), ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জাদুঘর(চলমান)সহ আরও কিছু ভবনের ডিজাইন করেছেন।
“প্রয়াস” প্রকল্পটি সম্পর্কে স্থপতি তানজিম হাসান বলেন, বগুড়া শহরের অদূরে মাঝিরা এলাকায় গড়ে উঠছে প্রয়াস প্রকল্প। যা সমাজের বিশেষায়িত শিশুদের শিক্ষা, সংস্কৃতির সুযোগ সুবিধা এবং গুণগত মান উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের অনেক শিশু কিশোর অটিজম স্পেকট্রাম ডিজাওয়াডের আক্রান্ত। এদের স্বাভাবিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করা শিক্ষার সুযোগ এবং সহ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনের প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া এই বিশেষায়িত বিদ্যালয় এর প্রচেষ্টা। এখানে শুধু বিশেষায়িত চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য ক্লাস রুম আছে তাই নয়, এখানে সাধারণ শিশুদের জন্য ক্লাস রুম আছে। এখানে মাল্টিপারপাস হল ও আছে, যা দুইটি ব্লকে সংযুক্ত করেছে। প্রজেক্টের ক্লাস রুম গুলো ক্যান্টিলিভার হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে যা আধুনিক নির্মাণ শৈলীর উদাহরণ। এই ক্যান্টিলিভারের নিচে সেমি ওপেন স্পেস তৈরি হয়েছে যেন রোদ বৃষ্টি থেকে শিশুরা রক্ষা পায় এবং বিদ্যালয়ের মাঠের বর্ধিত অংশ হিসেবে কাজ করে। ভবনটি যদিও চারতলা। তথাপি এমন ভাবে নকশা করা হয়েছে যেন তা আসে পাশের পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত হয়এবং ক্লাস রুমের দুটি ব্লকের মাঝখানে একটি উঠানের মতো স্পেস তৈরি হয়। যা ছায়াতে ঢাকা থাকে এবং ছাত্র ছাত্রীদের সমাবেশ এবং খেলার মাঠ হিসেবে কাজ করে। ভবনের
সম্পর্কিত

নিচতলায় দুটি ব্লকে একদিকে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অন্যান্য প্রশাসনিক দপ্তরসমূহ আছে এবং অন্য দিকে আছে ফিজিওথেরাপি, হাইড্রোথেরাপি, মিউজিক থেরাপি, কাউন্সিলিং, সেনসরি গার্ডেন এ ধরনের বিশেষায়িত যে সাহায্যের প্রয়োজন সেই ধরনের সহায়ক স্থান সমূহ।
প্রকল্পটির চারপাশে সবুজ মাঠ এবং খেলার জায়গা রয়েছে যা শিশুদেরকে শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলবে। শুধু মাত্র শিক্ষা সহায়ক স্থান ই নয়, বরং সহানুভূতিশীল এবং মানবিক সমাজ নির্মাণের জন্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ সুযোগ করে দেওয়া এবং একে অপরের মধ্যে যে বোঝাপড়া, গ্রহনযোগ্যতা এবং এক ধরনের সহানুভূতিশীল পরিবেশ যেন তৈরি করা যায় তাই ছিল এই নকশার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। মাল্টিপারপাস হলটি শুধু স্থাপত্যিক সংযোগ নয় বরং সাধারণ শিক্ষার্থী এবং বিশেষায়িত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংযোগ যেন ঘটতে পারে এবং তারা যেন এক ই হলে দলগতসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা খেলাধুলা এরকম নানা ধরণের এক্টিভিটি যেন করতে পারে তার জন্য এই মাল্টিপারপাস হলটি অবদান রাখবে। চারতলা বিশিষ্ট ভবনটির স্থানিক বিন্যাস এমন ভাবে করা হয়েছে যেন তা ব্যবহারকারীদের সহনীয় এবং দৃষ্টিনন্দন অভিজ্ঞতা পায় সেই বিষয়ে বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। পরিবেশের সাথে যেন এটা সুন্দর ভাবে সমন্বিত হতে পারে সেটার জন্য সচেতন ভাবে এখানে যে নির্মাণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে বা যে ধরনের কাঠামোগত নকশা করা হয়েছে, তাতে করে বলা যায় পরিবেশের সাথে এন্ট্রিগেশন, সমন্বয়ে সহনীয় সহাবস্থান যেন ভবনটি করতে পারে সেটার ব্যাপারে এই প্রকল্পটি যথেষ্ট সংবেদনশীল। দুটি পাশাপাশি শ্রেণী কক্ষের মাঝে কিছু খোলা জায়গা তৈরি করা হয়েছে, যা শুধুমাত্র আলো বাতাসের পরিচালন সেটাই নিশ্চিত করে না, এখানে শ্রেণী কক্ষের বাইরে কিছু সহ শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালানোর জন্য এই স্থান সমূহ ব্যবহার করা যাবে। ভবনের উপরের অংশে বৃত্তাকার কিছু পান্চ বা এক ধরনের ক্যাসেলিটেড কুড়ি কাঠের সাথে তুলনীয়।যা কাঠামোগত সমাধান থেকে এসেছে, যা দৃশ্যগত আভ্যন্তরীণ স্থান সমূহকে আলোকিত করে, এবং উজ্জীবিত করে। ভবনের অভ্যন্তরে বেশ কিছু ডাবল বা ট্রিপল হাইট স্পেস আছে, যা প্রতিটি ফ্লোরকে দৃশ্যগত সংযুক্ত রাখে। এতে করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের মধ্যে এক ধরনের আভ্যন্তরীণ স্থানের যে ভিজুয়াল ইন্টার কানেক্টিভিটি বা দৃশ্যপটের আন্তঃ সংযোগ এই বিষয়টি গুরুত্বপায়। ভবনের ছাদে সবুজ টেরাস। যেখানে শিশুরা প্রকৃতির কাছাকাছি হাঁটতে পারে, বসতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে নতুন জীবনের। শুধু একটি ছাদ নয়, এটি শিশুদের স্বস্তির একটি স্থানও।
সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের নৈতিক দায়িত্ব এই ধরনের উদ্যোগকে উৎসাহিত করা, যেন বিশেষায়িত শিশুরা কখনো মনে না করে তারা সমাজ থেকে বিচ্যুত। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও যেন এই বিশেষায়িত শিশুদের বুঝতে পারে এবং তাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয়, সংবেদনশীল হয় এই জন্য “প্রয়াস” প্রকল্প বাংলাদেশের একটি অনন্য উদ্যোগ।
তরুণ স্থপতিদের উদ্দেশ্যে স্থপতি তানজিম বলেন, স্থপতিরা যেন শহর, পরিবেশ এবং ব্যবহারকারী বা প্রয়োগিক বিষয়গুলোতে মনোযোগী হয়। স্থাপত্য- নির্মাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আধুনিক নির্মাণের ধারণা, টেকসই, কাঠামো এবং সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঠিক ও মানবিক প্রয়োগ প্রয়োজন। প্রয়োজন ধৈর্য, নিখ্ুঁততা, শৈল্পিক এবং ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং নৈর্ব্যক্তিক বিচার বিবেচনা। পরিমিতিবোধ যা থেকে এক ধরনের নন্দন বোধ তৈরি করা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই স্থাপত্যে রূঢ়তা প্রয়োজন হয়, যা স্থাপত্যকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে একটা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ আনতে সাহায্য করে। কাঠামো এবং স্থাপত্যিক সকল বিষয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। একটা ভবনের আয়ুস্কাল স্থপতি থেকে অনেক বেশি, কোনো ভুল হলে তা দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রভাব ফেলবে আবার উপকৃত হলে অনেক শতাব্দী মানুষ ভবন থেকে, স্থাপত্য থেকে , শহর থেকে উপকৃত হয়। স্থাপত্যের সাথে সাথে নির্মাণ, দর্শন, সমাজ, চিন্তা, সিনেমা, চারুকলা, ভাস্কর্য, পেইন্টিং, সাহিত্য, সকল বিষয়ের স্থপতিদের এক ধরনের ভাবনার তৈরি প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে প্রয়োজনীয় যে নান্দনিক নির্মাণ, ভবন থেকে শহরে, বন্দর থেকে বসতি, সকল ক্ষেত্রেই স্থপতিরা তাদের সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করতে কখনো কুন্ঠিত বোধ না করে। এই মেধা-শিক্ষা ও জ্ঞান প্রয়োগ করতে তারা যেন উৎসাহিত হয়। তারা যেন যথেষ্ট পরিমাণ পরিশ্রমী ও সাহসী যেন হয়ে উঠে। তাদের উদ্দেশ্যে এটাই আমার কামনা।